Sacred Games: ধর্ম, বিশ্বাস ও অপরাধের এক উপাখ্যান

“ভগবানে বিশ্বাস কর?”

গণেশ গাইতোণ্ডের এই সংলাপ দিয়েই শুরু হয় নেটফ্লিক্স প্রযোজিত প্রথম ভারতীয় সিরিজ ‘Sacred Games’। ইন্দো-আমেরিকান লেখক বিক্রম চন্দ্রের ২০০৫-এ লিখিত ‘Sacred Games’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিরিজটি। নামের মধ্যে পবিত্রতা থাকলেও ‘Sacred Games’ হচ্ছে সামাজিক বৈষম্য, অমানবিক হিংস্রতা, ধর্মীয় গোড়ামি, লালসা এবং ঈর্ষার উপাখ্যান।

কাহিনির প্রধান দুই চরিত্র হচ্ছে মুম্বাই মাফিয়া বস গণেশ গাইতোণ্ডে এবং পুলিশ অফিসার সারতাজ সিং। আইনের সীমার দুই ভিন্ন প্রান্তে অবস্থান এই দুজনের। গণেশ ৯০-এর দশকে মুম্বাই শহরে ত্রাসের রাজত্য কায়েম করা এক ঘৃণ্য অপরাধী, যে দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে আছে লোকচক্ষুর আড়ালে। অপরদিকে সারতাজ সিং দুর্নীতিগ্রস্ত, নীতিভ্রষ্ট এক সমাজে নিজের বাবার মত এক সৎ পুলিশ অফিসার হওয়ার চেষ্টারত এক পুলিশ ইন্সপেক্টর। কিন্তু পেশাগত ব্যর্থতা, ব্যক্তিগত জীবনের অপূর্ণতা এবং নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অন্যায়কে থামাতে না পারার অক্ষমতা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

সোজা চোখে দেখলে মনে হবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এই দুই মানুষের জীবনে কোনোধরনের সংযোগ থাকার কথা না। কিন্তু নিয়তির লিখনে তাদের দুইজনের জীবন এক সুত্রে বাধা। হতাশায় ভুগতে থাকা সারতাজের জীবনের মোড় ঘুরে যায়, যেদিন গণেশ গাইতোন্ডে নিজে তাকে ফোন করে। গাইতোণ্ডে সারতাজকে বলে দেয় তার হাতে ২৫ দিন আছে মুম্বাই শহরকে বাঁচানোর জন্য।

কী হতে চলেছে মুম্বাই শহরে ২৫ দিনে? কেন গাইতোণ্ডে সারতাজের মত এক সাধারণ পুলিশ ইন্সপেক্টরকে এটা জানালো? কি সম্পর্ক আছে গাইতোন্ডে আর সারতাজের মধ্যে? সারতাজ কি পারবে মুম্বাইকে বাঁচাতে? এসব প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজতে থাকি ‘Sacred Games’-এর প্রথম সিজনে।

গল্পটি এগিয়েছে দুইটি ভিন্ন টাইমলাইনে। প্রথমটি হচ্ছে গণেশ গাইতোণ্ডের গল্প। কীভাবে এক ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের পরিবারে জন্ম নেয়া গাইতোণ্ডে মুম্বাই শহরে রাজত্ব করা শুরু করল তার উপাখ্যান আমরা দেখতে থাকি। গাইতোণ্ডের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তার জীবনের ‘তিন বাবা’-র কথা আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারি। এই অংশটির পরিচালক ছিলেন অনুরাগ কাশ্যপ। আর তারই পাশাপাশি চলতে থাকে বর্তমানের কাহিনি, যেখানে সারতাজ সিং হন্যের মত গাইতোণ্ডের রহস্য সমাধান করে, মুম্বাই শহরকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছে। এই অংশটির পরিচালনা করেন বিক্রম আদিত্য মোতওয়ানি। 

Sacred Games-এর পরিচালক বিক্রম আদিত্য মোতওয়ানি এবং অনুরাগ কাশ্যপ

গণেশ গাইতোন্ডের ক্যারেক্টারটি করেছেন বলিউডের বর্তমান সময়ের সেরা ফর্মে থাকা অভিনেতা নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিআর শিখ অফিসার সারতাজ সিং-এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাইফ আলী খান। নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে আরো একটি পালক যুক্ত হল গণেশ গাইতোণ্ডের চরিত্রে অভিনয় করে। সিরিজে গাইতোণ্ডের হিংস্রতা এবং চূড়ায় উঠার প্রবল স্পৃহাকে নাওয়াজ নিপুণভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। ক্ষমতার চূড়ায় আসীন গাইতোণ্ডে যে নিজেকেই ভগবান বলে মনে করা শুরু করে, তাকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন নাওয়াজ। এই চরিত্রের মাধ্যমে আরেকবার বলিউডের চাকচিক্যের জগতে নিজের অনন্যতার প্রমাণ দিলেন নাওয়াজ।

কিন্তু এই সিরিজটির সবথেকে বড় চমক ছিলেন সাইফ আলী খান। নিজের ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ সময়ই প্রচলিত বলিউডি ছবিতে অভিনয় করে আসা সাইফ এবার নিজের পুরোনো সত্ত্বাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে সারতাজ সিং-এর চরিত্রে ডুবে যান। অনেকের আশঙ্কা ছিল নাওয়াজের মত অভিনেতার সাথে পেরে উঠতে পারবেন না সাইফ আলী খান। কিন্তু তাদের শঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করেছেন সাইফ।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘RAW’-এর এজেন্ট অঞ্জলি মাথুর-এর ক্যারেক্টারে দেখা যায় রাধিকা আপ্তেকে। সারতাজের পাশাপাশি সেও মুম্বাইকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে এবং নিজের সহকর্মীদের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন। বাকিদের মধ্যে সারতাজের সিনিয়র অফিসার পারুলকার (নিরাজ কবির), সারতাজের বিশ্বস্ত সহযোগী কনস্টেবল কাটেকার (জিতেন্দ্র জোশি), গাইতোণ্ডের প্রেমিকা কুকু (কুব্রা সাইত), স্ত্রী সুভদ্রা (রাজশ্রী দেশপাণ্ডে), গাইতোণ্ডের বিপক্ষ গ্যাং লিডার সুলাইমান ইসা (সৌরভ সাচদেবা), গাইতোণ্ডের গোড়া হিন্দু চেলা বান্টি (যতীন সারনা) ও ছোট রাজনীতিবিদ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি বনে যাওয়া বিপিন ভোসলে-এর (গিরিশ কুলকার্নি) চরিত্র গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রগুলো সিরিজের গল্পকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রেখেছে।

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হল সিরিজটির সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল ভারতে ধর্মকে কিভাবে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয় তার উপস্থাপনা। গাইতোণ্ডে কিভাবে ভিন্ন ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু এক ব্যক্তি থেকে সিরিজের শেষ পর্যায়ে এসে মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে পরে, রাজনীতিতে ধর্মীয় ভেদাভেদের ব্যবহার, পূর্বের মত বর্তমানেও ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মীয় নীতির পিছনে লুকিয়ে কিভাবে ক্ষমতাশালীরা নিজেদের কার্যসিদ্ধি করে তা খুব নিপুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

নেটফ্লিক্সে সেন্সরশিপ ভারতীয় চলচ্চিত্রের মত এতটা কঠোর না হওয়ায় মোতওয়ানি ও অনুরাগ কাশ্যপ পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে সিরিজটি চিত্রায়িত করেছেন। সিরিজটির কিছু দৃশ্যে নগ্নতা দেখানো হয়েছে। মাঝে মধ্যেই চরিত্রগুলো তাদের সংলাপে অশ্রাব্য গালি-গালাজ করেছেন। পুলিশ সেলে টর্চার এবং মানুষ হত্যার দৃশ্যগুলোকে অনেক বাস্তবিক রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই সিরিজটি অবশ্যই শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদেরই দেখা উচিৎ।

প্রথমবারের মত ভারতীয়দের জন্য, ভারতীয় কলা-কুশলীদের দ্বারা নির্মিত সিরিজ হচ্ছে ‘Sacred Games’। মুক্তির পূর্বে সিরিজটিকে নিয়ে প্রচুর আগ্রহ ছিল, শঙ্কা ছিল সিরিজটি এই বিপুল প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কিনা। কিন্তু মুক্তির পরেই এর সফলতা নিয়ে সকল সন্দেহ দূর হয়ে যায়। ভারতের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী নেটফ্লিক্সের দর্শকেরা পছন্দ করেছেন সিরিজটি। প্রথমবারের মত ক্রাইম-থ্রিলার জনরার একটি সফল সিরিজ তৈরি করতে পেরেছে ভারত। 

১ম সিজনের ৮টি এপিসোডে আমরা কিছু রহস্যের সমাধান খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু তার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নতুন অনেক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য আগামী বছরে ২য় সিজনের অপেক্ষায় রয়েছে আমার মত অসংখ্য ভক্ত। আর যারা এখনো সিরিজটি দেখেননি, তাদেরকে বলব জলদি দেখে ফেলুন। আশা করছি আপনাদের সময় নষ্ট হবে না। 

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *