আমরা কেউ ১৯৬২ এর বিশ্বকাপ ফুটবল দেখি নি; আমাদের বাবা-দাদারা সেই সময়ে জন্মেছেন ঠিকই কিন্তু বিশ্বকাপ দেখার সৌভাগ্য হয় নি। কারণ সেই সময়ে তো আর বাংলাদেশে টেলিভিশন ছিল না বা থাকলেও তা হাতে গোনা কয়েকটা। বাবা-দাদাদের যদি বিশ্বকাপ দেখার সৌভাগ্য হত তাহলে এই বাংলাদেশে ব্রাজিল সমর্থক বাদে আর কোন সমর্থক থাকত বলে মনে হয় না। এর কারণ বিশ্বকাপে দল সমর্থনে আমাদের দেশে তথাকথিত যে নিয়ম আছে সে নিয়ম অনুযায়ী বিশ্বকাপ সমর্থনের যে জীন আমরা আমাদের বাবা-দাদাদের থেকে পেতাম তার সাথে হয়ত বেকেনবাওয়ার, জর্জ বেস্ট, মিশেল প্লাতিনি বা ইয়েহান ক্রুইফের ফুটবল শৈলীকে প্রতিযোগিতায় নামানোই যেত না। যাই হোক সেই ১৯৬২ বিশ্বকাপের মহানায়ক হচ্ছেন “ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো দস সান্তোস” বা ভক্ত সমর্থকের কাছে “গ্যারিঞ্চা”। আজ তাঁর কথাই বলব।
পূর্ব পুরুষেরা দাস, বাবা মাতাল, পারিবারিক আয় রোজগার নেই বললেই চলে। এমন এক বিরূপ সামাজিক পরিবেশে ১৯৩৩ সালের ২৮ অক্টোবর ব্রাজিলের পাঁউ গ্রান্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন গ্যারিঞ্চা। খুব ছোটবেলায় পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর পা বাঁকা হয়ে যায় এবং ডান পায়ের তুলনায় বাম পা ৬ সে.মি. ছোট হয়ে যায়। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে কারখানায় কাজ নেন; যেখানে কারখানার মালিকের দলের হয়ে খেলার জন্য তিনি পেতেন খাবার আর মদ।
পেশাদার ক্যারিয়ারের প্রতি প্রথম থেকেই তার অনীহা ছিল। তাইতো ২০ বছর সময় লাগে গারিঞ্চার পেশাদার খেলোয়ার হিসাবে নাম লেখাতে। ১৯৫৩ সালের কথা, ব্রাজিলের তখনকার সুনামধন্য ক্লাব বোটাফোগো তে যোগদানের জন্য তাঁকে ট্রেনিং এ পাঠানো হয়। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ছিলেন স্বয়ং ব্রাজিল জাতীয় দলের ডিফেন্ডার নিলটন সান্তোস। ট্রেনিংয়ে সান্তোসকে রীতিমত বোকা বানান গ্যারিঞ্চা। তাঁর ড্রিবলিং দেখে সান্তোস ম্যানেজারের কাছে সুপারিশ করেন, গ্যারিঞ্চাকে যেন বোটাফোগোতে সাইন করানো হয়। তখন থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বোটাফোগোর হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন।
১৯৫৪ এর বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করা হল কিন্তু সেখানে গ্যারিঞ্চার নাম নেই!!!! কারণ তখন তার পজিশনে জুলিনহোকে অধিক যোগ্য বলে মনে করা হত। কিন্তু ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল নির্বাচকেরা আর ভুল করলেন না। দলে জায়গা পেলেন গ্যারিঞ্চা। কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচ তাকে মাঠে নামানো হল না। তৃতীয় ম্যাচ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। ঐ ম্যাচে বিশ্বকাপে প্রথম খেলার সুযোগ পেল পেলে এবং গ্যারিঞ্চা। একটা বিষয় খুব মজার, পেলে এবং গ্যারিঞ্চা একসাথে মাঠে থাকা অবস্থায় ব্রাজিল এক ম্যাচের জন্যও হারে নি।
এই ম্যাচের প্রথম থেকেই বেশ আক্রমণাত্বক ফুটবল খেলে ব্রাজিল দল। খেলার প্রথম তিন মিনিটেই গ্যারিঞ্চার একটি ও পরে পেলের আর একটি শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ফুটবল ইতিহাসে এই তিন মিনিটকে বলা হয় “দ্যা গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস অফ ফুটবলিং হিস্টোরি”।
এরপর থেকে তাঁকে আর সাইড বেঞ্চে বসে থাকতে হয়নি। ফাইনালে সুইডেনের কাছে প্রথমে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়লেও তার ফুটবল মননের কাছে হার মানে সুইডিশরা, ব্রাজিল ম্যাচটি জিতে নেয় ২-১ গোলে। গারিঞ্চা জিতে নেন বিশ্বকাপ ও কোটি কোটি ভক্ত সমর্থকের ভালোবাসা।
১৯৬২ বিশ্বকাপ তার জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর একক নৈপুণ্যে ব্রাজিল সেবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। বিশ্বকাপের আগে গ্যারিঞ্চার জীবনে প্রতিকূল কিছু ঘটনা ঘটে যায়। অতিরিক্ত মদ পানের জন্য তার বাবা লিভার ক্যান্সারে মারা যায়।
১৯৬২ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচেই যখন পেলে ইঞ্জুরিতে পড়েন, তখন ব্রাজিল দলের হাল ধরেন গ্যারিঞ্চা। কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ইংল্যান্ড ও সেমিফাইনালে স্বাগতিক চিলির বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার বাঁকানো সেই গোল আজও ভক্ত সমর্থকেরা মনে রাখে “বেনানা শট” নামে। ফাইনালের প্রতিপক্ষ যুগোস্লাভিয়া কিন্তু ব্রাজিল দলের প্রাণ গ্যারিঞ্চার তখন গায়ে অনেক জ্বর। সেই জ্বর নিয়েই দলকে জেতালেন ৩-১ গোলে। ইতালির পর পরপর দুই আসরে বিশ্বকাপ জয়ের খেতাব পেল ব্রাজিল। আর ব্রাজিলের এই কীর্তির মূল নায়ক ছিলেন গ্যারিঞ্চা।
১৯৬৬ এর বিশ্বকাপে গ্যারিঞ্চার ফিটনেস এবং গোড়ালিতে ইঞ্জুরি দেখা দেয়। ইঞ্জুরি স্বত্ত্বেও তিনি প্রথম ম্যাচে মাঠে নামেন এবং এক গোল করে দলকে জিতিয়ে আনেন। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচ ব্রাজিল ১-৩ গোলে হেরে যায়। যা ছিল গ্যারিঞ্চার ব্রাজিল দলের হয়ে প্রথম হার এবং একই সাথে শেষ ম্যাচ। এরপর ১৯৬৬ এর বিশ্বকাপে ব্রাজিল গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে।
ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ক্লাবের হয়ে। জিতেছেন অসংখ্য ট্রফি। ইউরোপের বিখ্যাত সব ক্লাব এসি মিলান, ইন্টার মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ তাঁকে দলে নেয়ার জন্য আগ্রহ দেখালেও তিনি যেতে রাজি হন নি। তাঁর প্রথম ক্লাব বোটাফোগোতে তিনি দীর্ঘ ১২ বছর অতিবাহিত করেন। তারপর একে একে করিন্থিয়ানস, আতলেটিকো জুনিয়র, ফ্লামিঙ্গো ও সবশেষে ওলারিও ক্লাবে তাঁর বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি করেন। এসব ক্লাবের হয়ে তিনি জিতেছেন প্রায় ২০টির মত শিরোপা।
সব ধরনের ফুটবল থেকে ১৯৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর অবসর নেন গারিঞ্চা। এর পেছনে কারণটি ছিল মজার। ১৯৭৩ সালে তার বয়স যখন ৪০ বছর তখন তিনি ইতিমধ্যে “নানা” হয়ে গিয়েছিলেন। তখন গারিঞ্চার মনে হল যে নানা হয়ে যাওয়ার পরে তার আর ফুটবল খেলা মানায় না। তাই তিনি সব ধরনের ফুটবল থেকে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু ব্রাজিলের দুইটি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক গারিঞ্চাকে কি আর সাদামাটাভাবে বিদায় দেয়া যায়। তাইতো ১৯৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য মারাকানা স্টেডিয়ামে বিশ্ব একাদশ বনাম ব্রাজিলের ম্যাচ আয়োজন করে। সেখানেই ভক্তদের কাছ থেকে বিদায় নেয় লেজেন্ড গ্যারিঞ্চা।
ব্রাজিলের মানুষের কাছে “পিপলস জয়” আর “বেন্ট লেগ এঞ্জেল” খ্যাত গ্যারিঞ্চা ব্যক্তিগত পর্যায়ে জিতেছেন অনেক ট্রফি। ১৯৬২ বিশ্বকাপে জিতেছেন একই সাথে গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট। ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত “ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ অল টাইম টিম” এ স্থান পেয়েছেন। ১৯৬২ সালে জিতেছেন ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ পুরষ্কার ব্যালন ডি’অর সহ ছোট বড় অসংখ্য ট্রফি। ফুটবলের এই মহান বোদ্ধা ১৯৮৩ সালের ২০ জানুয়ারী লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
আজ আমাদের মাঝে গ্যারিঞ্চা নাই সেটা ঠিক। কিন্তু তাঁর অনন্য ফুটবল মনন বিশ্ব ফুটবলকে এখনো প্রভাবিত করে চলেছে। আজো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে মনে রেখেছে বলেই তাঁর নামে ব্রাসিলিয়াতে দেখা যায় “এস্তাদিও ন্যাশিওন্যাল মানে গ্যারিঞ্চা”। তাঁর ড্রিবলিং, বল কন্ট্রোল, ফিনিশিং সর্বোপরি মনের আনন্দের সাথে ফুটবল খেলা, ফুটবল খেলাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, সবকিছুই উৎসাহিত করেছে পরবর্তী প্রজন্মের ফুটবলারদের। সক্রেটিস, রোমারিও, রিভালদো, রোনালদিনহো, কাকা ও বর্তমানের নেইমার, সকলেই গারিঞ্চার দেখানো ব্রাজিলিয়ান শৈল্পিক ফুটবলকে তাদের ফুটবলে ধারণ করেছেন। ইতিহাস গ্যারিঞ্চাকে শৈল্পিক ফুটবলের অন্যতম পথদিশারী হিসেবে চিরকাল মনে রাখবে।