১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ থেকে শুরু; ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে নাস্তানাবুদ। ফলাফল ৪-২ এ হার। এরপর ১৯৭০ এর মেক্সিকো বিশ্বকাপ ; এবার আর ফাইনাল নয়, সেমিতেই ইতালির কাছে বধ; অতিরিক্ত সময়ের খেলায় যা নিষ্পত্তি হয় ৪-৩ গোলে, যা ফুটবল ইতিহাসে “গেম অব দ্য সেঞ্চুরি” নামে পরিচিত।
বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে “নেড়া বেলতলায় একবারই যায়”। একবার ফাইনাল থেকে শূণ্য হাতে ফিরেছি, আর নয়। এই প্রবাদটি হয়ত তাদের কানে কানে কোনো বাঙালী জপে গিয়েছিল।
দানে দানে তিন দান; ৭৪’র পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ। ইতালির সিলভিও গাজ্জানিগার নকশার নতুন বিশ্বকাপ ট্রফি। সেরা সুযোগ এইটাই। বিশ্বকাপকে দুই হাত ভরে স্পর্শ করার মঞ্চটা সাজালেন তাই নিজের মাটিতেই। যেমন পরিকল্পনা, তেমন কাজ। ফাইনালে ইয়েহান ক্রুইফের টোটাল ফুটবলকে হার মানিয়ে বিশ্বকাপকে দুই হাতে জাগিয়ে ধরলেন, সে আর কেউ না ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার; দি কাইজার।
জর্জ বেস্ট, মিশেল প্লাতিনি, ইয়েহান ক্রুইফরা ১৯৯০ এর বিশ্বকাপের পরে হয়ত একটু বেশিই ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন; তাদের মত বাঘাবাঘা খেলোয়ার যেখানে বিশ্বকাপকে ছুঁতে পর্যন্ত পারে নি, সেখানে বেকেনবাওয়ার ছুঁয়েছেন দুইবার; অধিনায়ক হিসাবে, ম্যানেজার হিসাবে। এমন কৃতি বেকেনবাওয়ার ছাড়া কোনো ফুটবলারের নাই। আর আজ সেই মহানায়ককে নিয়ে লিখব।
“জুসপেসত্রাসা নাম্বার ৬” মিউনিখ শহরের বাড়িটিতে বেকেনবাওয়ার জন্মগ্রহণ করেন ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ১৯৫৪ সালে পশ্চিম জার্মানি প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা উৎসাহিত করেছিল আগামী প্রজন্মকে। ৫৪ বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলারদের আইডল মেনে বেকেনবাওয়ার মাত্র ৮ বছর বয়সে যোগ দেয় “এস সি মিউনিকো ০৬” ক্লাবে। ১৯৫৯ সালে ডাক পেলেন বায়ার্ন মিউনিখে।
মিউনিখের ক্লাবটি তখনও বুন্দেসলীগায় নাম লেখাতে পারে নি। ঠিক তখন তিনি ফুটবল ইতিহাসে নতুন পজিশনের সৃষ্টি করলেন; যা হচ্ছে সুইপার বা লিবারু। যে একই সাথে প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলাতে এবং প্রতি আক্রমণে প্রতিপক্ষের রক্ষণ গুড়িয়ে দিতে সক্ষম।
১৯৬৪ সালে সিনিয়র দলের নিয়মিত খেলোয়ার হিসাবে নাম লেখালেন। নাম লেখিয়েই যেন বাজিমাত , বায়ার্ন মিউনিখ বুন্দেসলীগায় উত্তীর্ণ হল। ৬৮ সালে তাকে দলের প্রধান ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড তুলে দিলেন বায়ার্ন কোচ। এরপর বায়ার্নের হয়ে বুন্দেসলীগা জিতেছেন ৫ বার, জার্মান কাপ জিতেছেন, ৭৪-৭৬ টানা তিন বছর ইউরোপা কাপ সহ বায়ার্নের হয়ে জিতেছেন সর্বমোট ১৪ টি ট্রফি।
১৯৭৭ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক কসমস এ। সেখানে জিতেছিলেন তিন বার লীগ টাইটেল।
১৯৮০ সালে আবার ফিরে আসা সেই চিরচেনা বুন্দেসলীগায়। তবে এবার বায়ার্ন নয় হামবুর্গ এস ভি এর হয়ে। হামবুর্গের হয়ে জেতেন ১৯৮২ বুন্দেসলীগা। তিনি ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানেন নিউ ইয়র্ক কসমসের হয়ে ১৯৮৩ সালে।
জাতীয় দলে বেকেনবাওয়ারের অভিষেক ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫। বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনটি ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৭৪ সালে। পশ্চিম জার্মানির অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরার সৌভাগ্য তাঁর হয় ১৯৭২ সাল থেকে। অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন ৭২ এর ইউরো কাপ ও ৭৪ এর বিশ্বকাপ। জাতীয় দলের হয়ে ১০৩ ম্যাচে করেছেন ১৪ টি মূল্যবান গোল।
অধিনায়ক হিসাবে বেকেনবাওয়ার যেমন সফল, তেমনি ম্যানেজার হিসাবেও সফল। জিতিয়েছেন পশ্চিম জার্মানিকে ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ, অলিম্পিয়াকো ডি মার্শাই এর হয়ে ফ্রেঞ্জ চ্যাম্পিয়নশিপ, বায়ার্নের হয়ে ১৯৯৪ এর বুন্দেসলীগা ও ১৯৯৬ এর উয়েফা কাপ। ম্যানেজার হিসাবে ইতি টানেন বায়ার্ন থেকেই।
ম্যানেজার পদটি ছেড়ে দিলেও বেকেনবাওয়ার তাঁর প্রিয় ক্লাবের সঙ্গ ছেড়ে যাননি। ১৯৯৪ থেকে ২০০৯, দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি বায়ার্ন মিউনিখ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি দুইবার ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলার-এর খেতাব পান। ১৯৯৮ সালে ফিফার ” বিংশ শতাব্দির বিশ্ব একাদশ”-এ এবং ২০০২ সালে “ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ ড্রিম টিম”-এ স্থান পান বেকেনবাওয়ার।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার জার্মানি তথা ফুটবল বিশ্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বেকেনবাওয়ার তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পেয়েছেন সফলতা। সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে তা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, ফুটবলের সবক্ষেত্রে সফল হওয়ার উদাহরণ ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার-এর মত আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি আজীবন থাকবেন ফুটবলের “কাইজার”(সম্রাট) হয়ে।