হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন আপনি। এককালের “মসজিদের নগরী” বলে পরিচিত এই ঢাকা শহরকে এখন “ফেসবুকারদের নগরী” বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কিছুদিন আগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ শহরটির ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন।তাই ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এই মেগাসিটি।
যুক্তরাজ্যের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল লিমিটেড’ ও কানাডার ‘হুটস্যুট ইনকরপোরেশন’ এর এক যৌথ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিষয়ক গবেষণা ও ডিজিটাল সেবাদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠান দুটি পরিচিত।
এছাড়াও গত বছরের জানুয়ারি মাসে উই আর সোশ্যালের করা প্রতিবেদনে ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। সে সময় ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ। অর্থাৎ গত তিন মাসে ঢাকায় ফেসবুক ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় ৬০ লাখের মতো। একবার চিন্তা করে দেখুন, তিন মাস অর্থাৎ নব্বই দিনে ৬০ লাখ! মানে, দিনের হিসেবে যদি বলা হয়, তাহলে প্রতিদিনে ঢাকায় অন্তত ৬৭ হাজারের মতো ফেসবুক একাউন্ট খোলা হয়েছে। এখনকার অবস্থা দেখে মনে হয়, কাজের মেয়ে মর্জিনা থেকে চায়ের দোকানদার মকবুল- সবার এক হুজুগ, ফেসবুক, ফেসবুক!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ফেসবুকের এতো জনপ্রিয়তার পেছনে রহস্যটা কী? কেননা, আরো অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই তো আছে, তবুও কেন ফেসবুক? এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে নিম্নের কিছু নিয়ামকের মধ্যে-
নতুনত্বঃ ২০০৪ সালে যখন মার্ক জুকারবার্গ হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য ফেসবুক আবিষ্কার করেন, তখন তা প্রচলিত অন্য সকল সোশ্যাল শেয়ারিং সাইট, যেমন- ব্লগ, মাইস্পেস ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অনন্য বলে প্রতীয়মান হয়। যা এই সাইটটির প্রতিষ্ঠাতাকে অনুপ্রাণিত করে, ফেসবুককে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার পর ফেসবুক তার এই অভিনবত্বের কারণে বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। শুরু হয় এক নতুন ঝড়ের। সে ঝড় ক্যাটরিনা, সিডর কিংবা আইলা নয়, সে ঝড় “ফেসবুক ঝড়”। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও বাদ পড়েনি এ ঝড়ের(?) কবল থেকে। যেটি ঢাকা শহরের দ্বিতীয় স্থান অধিকারের মধ্য দিকে এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
সহজবোধ্যতাঃ বাংলাদেশের মানুষদের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয় হয়ে উঠবার নেপথ্যে আরো যে নিয়ামকটি কাজ করেছে, তা হলো এর সহজবোধ্যতা। শুধুমাত্র একটি মোবাইল নম্বর অথবা ইমেইল অ্যাড্রেস দিয়ে যে কেউই নিখরচায় ফেসবুকে একটি একাউন্ট খুলতে পারবেন। আর এর ইন্টারফেস এতোটাই ইউজার ফ্রেন্ডলি যে, একজন অক্ষর-জ্ঞান সম্পন্ন থেকে শুরু করে একজন স্নাতকোত্তরও কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন। ফেসবুকের মূল সার্থকতাটা এখানেই।
বহুমুখীতাঃ ফেসবুক যেমন অভিনব আর সরল, তেমনভাবেই এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। বিশ্বাস হচ্ছে না? দু-একটা উদাহরন দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।
নতুন কারো সাথে পরিচিত হতে চান? বন্ধুত্ব করতে চান? চিন্তা নেই, আছে ফেসবুক। আজকালতো ফেসবুকে পরিচয়ের সুত্র ধরে বিদেশীরাও ঘর ছেড়ে চলে আসছে এদেশে। কোনো ব্যাপারে সবাইকে একত্র করতে চান? ফেসবুক আছে আপনার সহায়তায়। বন্ধুদের সাথে ছবি, ভিডিও শেয়ার করতে চান? আছে ফেসবুক। নিজের কথা, চিন্তা-ভাবনা জানাতে চান সবাইকে? হোয়াই টেনশন, ফেসবুক ইজ হেয়ার!
মোদ্দা কথা, ফেসবুকের ব্যবহার এতো বহুমুখী আর বিচিত্র যে, তা মাঝে মাঝে চিন্তা করাই দুস্কর হয়ে পড়ে। যদিও ফেসবুকের এই বিচিত্র ব্যবহারের সবগুলোই যে ইতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে, তাও বলা যাবে না। কিন্তু এই বহুমুখীতাই বাংলাদেশের মানুষদের আকৃষ্ট করেছে সবচেয়ে বেশী।
অনুকরণপ্রিয়তাঃ মানুন কিংবা নাই মানুন, আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা একটু অনুকরণপ্রিয়। পাশের বাড়ির ভাবি কী কিনলো থেকে শুরু করে বাড়ির ছাদে ভিনদেশী পতাকা ওড়ানো, সবই এই অনুকরণপ্রিয়তার মধ্যে পড়ে। আর এই অনুকরণপ্রিয়তাই যে এদেশে ফেসবুকের প্রচার ও প্রসারে অন্যতম “লিমিটিং ফ্যাক্টর” হিসেবে কাজ করেছে, সেটা বলার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হবার দরকার পড়েনা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যখনই কেউ ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে, তখন তা অন্য সবাইকে পরোক্ষভাবে ফেসবুকে
অ্যাকাউন্ট খুলতে প্রভাবিত করেছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি ডমিনো ইফেক্ট সৃষ্টি করেছে, যেখানে শুধু প্রথম ডমিনোটিকেই টোকা দিতে হয়, অবশিষ্টগুলো আপনা–আপনি পড়তে শুরু করে।
এতো গেল ফেসবুকের জনপ্রিয়তার পেছনের গল্প। তবে এই জনপ্রিয়তার জোয়ার যে শুধুই ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তা কিন্তু নয়। ফেসবুকের মাধ্যমেই ভেঙ্গেছে অনেক সংসার। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়ানোর মতো গুরুতর অভিযোগও আছে এর বিরুদ্ধে। তবে “দোষটা ছুরির নয়, ব্যবহারকারীর” এ অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে সাফাই গেয়েছেন এর উদ্ভাবকরা। যদিও সঠিকভাবে তদারকি না করতে পারার দায়টা তারা এড়াতে পারবেন না কোনোভাবেই।
একটা সময় ছিল যখন ডিপ্রেশনের রোগীদেরকে ফেসবুকে একাউন্ট খোলার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু আজকের এই উন্নাসিকতার যুগে, অনেক সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও যে নিজের স্ট্যাটাস বা পোস্টে লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের ঘাটতি দেখে ডিপ্রেশনে ভুগবেন না, সে গ্যারান্টি দিবে কে? তাই মুজতবার ভাষায়ই বলি,
“কুইনাইন ম্যালেরিয়া সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?”