১৪ই এপ্রিলের সকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। অন্য যেকোনো দিনে যেখানে এতো সকালে লোকসমাগম খুব কম থাকে। কিন্তু আজ তো কোনো সাধারণ দিন নয়। আজ যে পহেলা বৈশাখ। বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক এক মিলনমেলা। আর ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে এই উৎসবের সব থেকে আকর্ষণীয় পর্বের। বিশ্ববিখ্যাত মঙ্গল শোভাযাত্রা-র।
বাঙ্গালিরা সেই আকবরের সময় থেকেই উদযাপন করে আসছে নববর্ষকে। সেই সময়ে প্রজারা চৈত্রমাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং কিছু আনন্দ উৎসব করা হতো। এছাড়া বাংলার সকল ব্যবসায়ী ও দোকানদার পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। পহেলা বৈশাখ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।
নববর্ষ উদযাপন নতুন রূপ পায় ১৯৮৯ সালে। সে বছরই প্রথমবারের মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। যদিও এই শোভাযাত্রা প্রথম হয়েছিল ১৯৮৫ সালে যশোর শহরে। ‘চারুপীঠ’ নামক এক সংগঠন এর আয়োজন করে। সেই শোভাযাত্রা যশোর শহরে জনপ্রিয়তা পায়। পরের বছর শহরের আরো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো একত্রিত হয় এই আয়োজনে। চারুপীঠের কর্ণধার মাহবুব জামাল শামীম, হিরণ্ময় চন্দ ঢাবির চারুকলা ইনস্টিটিউটেরই প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৮তে তারা আবার ফিরে আসেন চারুকলা ইনস্টিটিউটে। আর তাদের উৎসাহে ও অন্য শিক্ষার্থীদের শ্রমে ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মত ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। পরের বছর ১৯৯০-এর শোভাযাত্রায় ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেন।
শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ।
মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা মাত্র ৩ দশক পূর্বে হলেও ইতিমধ্যেই তা বাঙালি জাতির নতুন বছর উদযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ২০১৬-র ডিসেম্বরে জাতিসংঘ এই শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় গত বছরের অপশক্তিকে পিছনে ফেলে নতুন দিনের আবাহন করা হয়। যদিও অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে এই শোভাযাত্রা, তবুও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক রূপে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এখন পুরো বাংলাদেশ জুড়েই নববর্ষ উদযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই শোভাযাত্রা। আর এভাবেই যশোরের কিছু সংস্কৃতিমনা মানুষদের নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এই পন্থা এখন সমগ্র বাংলাদেশের জাতীয় কৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে।