ভাগ্যকে দোষারোপ করে নিজের জীবনের ব্যর্থতা ঢাকা খুবই সোজা। কিন্তু যদি থাকে ইচ্ছাশক্তি, তাহলে একজন মানুষ তীব্র প্রতিকূল অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। তেমনই একজন মানুষ সানি জ্যাকব, যিনি নির্দোষ হয়েও কারারুদ্ধ ছিলেন ষোলটি বছর। তবুও সানি জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট। কেননা কারাবাস থেকেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন জীবনের উদ্দেশ্য।
১৯৭৬ সালের দিকে সানি এবং তার স্বামী জেসে টাফেরোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ৫ বছরের জন্য সলিটারী কনফাইনমেন্টে বন্দী করা হয় এ দম্পতিকে। ফলে বাইরের পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তারা। সানির ৯ বছর বয়সী ছেলে এবং দশ মাস বয়সী মেয়ে তাদের নানা-নানির কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সানির সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমে যাবজ্জীবনে নেমে আসে। কিন্তু টাফেরোর ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না। ৭ বছর পর সাড়ে ১৩ মিনিট বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্মমভাবে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। শক দেয়ার এক পর্যায়ে তার সারা দেহে আগুন ধরে যায়। নিজের বাবার এই করুণ মৃত্যু সহ্য না করতে পেরে তাদের ১৫ বছরের কন্যা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে।
আপিলে সানির সাজা হ্রাস পায়। মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু তার স্বামীর রায় আপিলে বহাল থাকে। রায় ঘোষনার ৭ বছরের মাথায় বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে সানির স্বামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সাড়ে তেরো মিনিট ধরে বৈদ্যুতিক শক প্রদানের কারণে তার দেহে আগুন ধরে গিয়েছিলো। বাবার এমন করুণ মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে তাদের পঞ্চদশী কন্যা আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবার পর সানিকে সাধারণ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। তিনি আবারো নিজের সন্তানদের সাথে দেখা করা এবং কথা বলার সুযোগ পান। কিন্তু তার কাছে নিজের সন্তানদেরকেও অচেনা বলে মনে হয়। এর কিছুদিন পরে বিমান দুর্ঘটনায় তার বাবা-মা দুইজনই প্রাণ হারান।
এদিকে সানির স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন পর, আসল হত্যাকারী, টাফেরো দম্পতির এক পুরোনো বন্ধু, পুলিশ হত্যার দায় স্বীকার করে।
কারাগারে বন্দীবস্থায় টাফেরো ও সানি জ্যাকব।
দীর্ঘ সতেরো বছর কারাবাসের পর ১৯৯২ সালে সানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। পয়তাল্লিশ বছর বয়সে সন্তানদের সাথে নিয়ে তিনি নতুনভাবে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে সানি এই নতুন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েননি।নিরাপরাধ সানি যখন কারাকুঠুরীতে একাকী বসে মৃত্যুর প্রহর গুনতেন, তখন বাইবেলের একটি বানী তার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। সানি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আসলে মৃত্যু এমন একটি বিষয়, যার ওপর কারো কোনো হাত নেই। মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার অধিকারটা একান্তই নিজের। তার সামনে দুটি পথ খোলা ছিলোএক, আশাহত হয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করে ক্ষান্ত দেয়া।।
দুই, আশাহত না হয়ে জীবনকে পূর্নবিন্যস্ত করে পরিচালনা করা।
সানি দ্বিতীয়টিই বেছে নিলেন। কারারুদ্ধ অবস্থায়ই তিনি যোগব্যায়াম এবং আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন শুরু করলেন। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সানি যোগব্যায়াম শেখানো শুরু করেন। সেইসাথে নিরপরাধ হয়েও দন্ডিতদের মুক্তি এবং তাদের পূর্নবাসনে আত্মনিয়োগ করেন।
আজ সানি একজন সফল বক্তা ও লেখিকা। তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন The Sunny Center তার মতোই যারা ভুল বিচারের শিকার, তাদেরকে আইনি সহায়তা প্রদান এবং পূনর্বাসনে সহায়তা করে থাকে।
সানি জ্যাকব তার জীবনে অসংখ্যবার হোঁচট খেয়েছেন। তার জায়গায় থাকলে বেশিরভাগ মানুষ শুধু নিজের জীবনকে দোষারোপ করে যেতো। কিন্তু সানি কখনোই তার ভাগ্যকে দোষারোপ করেননি। তার মতে, পেছনের গ্লানি ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত।
“প্রত্যেকেই তাদের জীবনে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। হয় অাপনি সারাজীবন পেছনের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকতে পারেন, অথবা পেছনের স্মৃতি মাথা থেকে ঝেটিয়ে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেন।”
– সানি জ্যাকব