সালটা ২০০০। হিন্দি চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায় আত্মপ্রকাশ ঘটে এক ২৬ বছর বয়সী যুবকের। বলিউডের স্বজন প্রীতির অলিখিত নিয়ম মেনেই যেন অভিনেতা বাবার পরিচালনায় বলিউডে প্রবেশ করেন তিনি। তারপর কেটে গিয়েছে দুই দশক। বিশ বছরে অনেক কিছু পালটে গেলেও বদলায় নি একটি জিনিস। শতাব্দীর সূচণাতে প্রথম দর্শনেই হিন্দি সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া এই অভিনেতা এখনো সেভাবেই জনপ্রিয়তার শীর্ষেই রয়ে গেছেন। বিশ বছরে অসংখ্য বাঁধা, চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে তাকে, বক্স-অফিসে সাফল্য-ব্যর্থতা উভয়েরই স্বাদ পেয়েছেন। ব্যক্তিজীবনেও বিতর্ক তাকে পিছু ছাড়ে নি। কিন্তু এত সবের মাঝেও তার প্রতি ভক্তদের ভালোবাসা কখনোই কমে যায়নি বরং তা দিনে দিনে যেন আরো বেড়ে চলেছে। নিজেকে তিনি বলিউডের খানদের ও বর্তমান নায়কদের সেতু বন্ধনকারি অভিনেতা বলে মনে করলেও তার ভক্তদের চোখে তিনি বলিউডের আদর্শ নায়কের ব্লুপ্রিন্ট। আশা করি এতক্ষণে বুঝেই ফেলেছেন বলছি বলিউডের হার্টথ্রোব হৃতিক রোশনের কথা ।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
হৃতিক ১৯৭৪ সালের ১০ই জানুয়ারি মুম্বাই শহরে এক পুরোদস্তুর বলিউড পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক রাকেশ রোশন ও পিঙ্কি রোশন দম্পত্তির কনিষ্ঠ সন্তান হৃতিক। হৃতিকের দাদা রোশনলাল নাগরথ ছিলেন একজন চলচ্চিত্র সঙ্গীত পরিচালক ও নানা জে. ওম প্রকাশ একজন পরিচালক। মুম্বাই শহরের বোম্বে স্কটিশ স্কুলে মাধ্যমিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে একই শহরের সিডেনহাম কলেজে কমার্সের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণ করেন তিনি।
অভিনয়ের পথে বাঁধা
হৃতিকের জন্ম এক বলিউড সংশ্লিষ্ট পরিবারে হলেও তার অভিনয় জীবনের পথে ছিল একাধিক বাঁধা। জন্মের সময়েই হৃতিকের ডান হাতে জোড়া বৃদ্ধাঙ্গুল ছিল, যার জন্য স্কুলের সহপাঠীরা তাকে ব্যাঙ্গ করত। পরবর্তীতে অপারেশন করে আঙ্গুল স্বাভাবিক করার সুযোগ থাকলেও হৃতিক তা করেন নি। নিজের এই ভিন্নতাকে গ্রহণ করেছেন আর ক্যামেরার সামনে কখনোই তা লুকানোর চেষ্টা করেন নি।
ছয় বছর বয়সেই হৃতিকের কথা বলায় জড়তা দেখা যায়। সেই সমস্যা থেকেও তিনি ঘুরে দাড়ান স্পিচ থেরাপিস্ট ও আত্মদৃঢ়তার মাধ্যমে।
চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিষেকের কয়েক বছর আগেই হৃতিক জানতে পারে যে সে ভুগছে লিভার স্কোলিওসিস রোগে। চিকিৎসকরা তাকে নাচ, স্টান্ট ও স্টেজে যেকোনো ধরনের পারফর্মেন্স করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। কিন্তু তারপরও হৃতিক থেমে থাকেনি। চিকিৎসা ও রুপালি পর্দায় নায়ক হিসেবে পদার্পণের প্রস্তুতি,দুইটিই সমান তালে চালাতে থাকেন তিনি। আর এখন নিজের রোগকে জয় করে তিনি হয়ে উঠেছেন বলিউড সিনেমার সেরা নাচিয়েদের মধ্যে একজন।
নায়ক হিসেবে আবির্ভাব ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ
মাত্র ছয় বছর বয়সেই শিশুশিল্পী হিসেবে ‘আশা’ ও ‘আপ কে দিওয়ানে’ ছবির গানের দৃশ্যে কাজ করেন হৃতিক। জীবনের প্রথম পারিশ্রমিক, ১০০ রুপি, তিনি পান অভিনেতা জিতেন্দ্রের কাছ থেকে আশা ছবিতে কাজ করার জন্য। সেই টাকা দিয়ে ১০টি হট ওইলসের গাড়ি কিনেছিলেন হৃতিক। তারপরে আরো কয়েকটি ছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে ছোট চরিত্রে কাজ করেন হৃতিক।
প্রীতি জিনতার বিপরীতে শেখর কাপুরের বাতিলকৃত ‘তারা রাম পাম পাম’ ছবির মাধ্যমে পর্দায় নায়ক হিসেবে তার অভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে বাবা রাকেশ রোশনের ‘কাহো না… প্যায়ার হ্যায়’(২০০০) ছবিতে আরেক অভিষিক্ত আমিশা পাটেলের বিপরীতে নায়ক হিসেবে বড় পর্দায় দর্শকদের সামনে প্রথমবারের মত আসেন ।
প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করে ফেলেন হৃতিক। সেইবছরের সবথেকে ব্যবসাসফল হিন্দি ছবি হয় ‘কাহো না… প্যায়ার হ্যায়’। সেই বছর ফিল্মফেয়ারে একইসাথে সেরা নবাগত ও সেরা অভিনেতার পুরস্কার বগলদাবা করে ফেলে হৃতিক। রাতারাতি পেয়ে যান তারকাখ্যাতি। শাহরুখ, সালমান, আমিরদের পাশাপাশি ভারতীয় তরুণীদের স্বপ্নের নায়কদের কাতারে জায়গা করে নেন হৃতিক। ২০১৯ সালে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হৃতিক জানান যে ‘কাহো না… প্যায়ার হ্যায়’ মুক্তির পরে তিনি ৩০ হাজারটি বিয়ের প্রস্তাব পান।
উত্থান, পতন আবারো উত্থান
প্রথম ছবিতে অকল্পনীয় সাফল্য পাওয়ার পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি হৃতিককে। পরের বছর অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, কাজল, কারিনা কাপুরের সঙ্গে অভিনয় করেন আরেক ব্লকবাস্টার ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ ছবিতে। ২০০৩ সালে বাবার পরিচালনায় তাকে দেখা যায় ‘কোই… মিল গেয়া’ ছবিতে প্রীতি জিনতার বিপরীতে। সেই ছবির পরবর্তী কিস্তি ‘কৃষ’ (২০০৬) ও ‘কৃষ ৩’ (২০১৩)-এ তাকে দেখা যায় হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রথম সুপার হিরো হিসেবে।
২০০৬ সালে ‘ধুম ২’ ছবিতে অ্যান্টি হিরোর চরিত্রে তাক লাগিয়ে দেন সকলকে। দুই বছর পর ‘যোধা আকবর’(২০০৮) মোঘল সম্রাট আকবরের চরিত্রে অভিনয় করেন।
২০১০ সাল অভিনয়জীবনের সবথেকে কঠিন সময় পার করতে হয় হৃতিককে। পরপর দুইটি ছবি ‘কাইটস’ ও ‘গুজারিশ’ ফ্লপের কাতারে পরে যায়। কিন্তু পরের বছরই তার ‘জিন্দেগী না মিলেগী দোবারা’ (২০১১) ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য আর বিশ্লেষকদের বাহবা দুইই পায়। ২০১২-তে ১৯৯০ সালের ‘অগ্নিপথ’ ছবির রিমেকে অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
২০১৬ সালে ‘মহেঞ্জো দাড়ো’-তে তিনি তার ভক্তদের হতাশ করলেও, পরের বছরই বাবার পরিচালনায় ‘কাবিল’ ছবিতে আবারো দর্শকদের মন জয় করে নেন।
২০১৯-এ প্রথমে ‘সুপার ৩০’-তে ভারতীয় শিক্ষক আনন্দ কুমারের চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন হৃতিক ও পরে ‘ওয়ার’ ছবিতে তরুণ তুর্কি টাইগার শ্রফের সাথে তার যুগলবন্দী দর্শকদের দেয় নিখাদ বিনোদন।
ব্যক্তি জীবন
২০০০ সালেই প্রেমিকা সুজান খানকে বিয়ে করেন হৃতিক। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলে, রিধান ও রিহান। কিন্তু ২০১৪ সালে এই দম্পতি তাদের ১৪ বছরের সম্পর্কের ইতি টানেন।
কাইটস ছবির শুটিং-এর সময় অভিনেত্রী বারবারা মোরির সাথে হৃতিকের সম্পর্কে জড়ানোর খবর একসময় চাওর হলেও দুইজনই সম্পর্কের খবরকে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়।
২০১৬ সালে কৃষ ৩-এর সহঅভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াতের সাথে তার সম্পর্কের কথা প্রকাশ পায়। দুইজনই সম্পর্কের ব্যাপারে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ দিয়ে তারা তাদের মধ্যকার তিক্ততা সকলের সামনে নিয়ে আসে। ২০১৬-তে কঙ্গনা এক সাক্ষাৎকারে হৃতিককে ‘silly ex’ বললে হৃতিক তার বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠায়। কঙ্গনাও তারপর হৃতিকের বিরুদ্ধে পালটা আইনি নোটিশ পাঠালে তাদের মধ্যকার এই কাদা ছোড়াছোড়ি সবার প্রকাশ্যে চলে আসে। উভয় পক্ষ পরবর্তীতে আইনি দিক দিয়ে আর অগ্রসর হয়নি।
চলতি বছরেই সুপার হিরো কৃষ রুপে আবারো পর্দায় আসার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হৃতিক। তার পাশাপাশি তিনি নিজের লাইফস্টাইল প্রতিষ্ঠান ‘HRX’ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
তথ্যসূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Hrithik_Roshan
https://www.bollymoviereviewz.com/2013/08/hrithik-roshan-upcoming-movies-2013-2015.html
ফিচার ইমেজঃ