‘বাংলার তাজ’ তাজউদ্দীন আহমেদ

“সাধারণ, অসাধারণ, ছোট, বড় কোনো অভিজ্ঞতাই ফেলে দেবার নয়। সব অভিজ্ঞতাই জীবনের বিভিন্ন ফুলে গাঁথা মালা।”

(ময়মসসিংহ জেলে বসে স্ত্রীকে লেখা তাজউদ্দীনের চিঠির অংশ বিশেষ)

এমন ছোট-বড় নানা অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল তাজউদ্দীন আহমদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, একথা আমরা সবাই জানি। কিন্ত যা জানি না তা হল এই ক্ষুরধার মস্তিষ্ক সম্পন্ন, বজ্রের মত দৃঢ় মানুষটি না থাকলে, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মাত্র নয় মাসে আমরা কখনোই স্বাধীনতা পেতাম না। যখন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীসভার সবাই পাকিস্তানের সাথে সমঝোতায় রাজি হয়ে গিয়েছিল তখন তাজউদ্দীন আহমদের দৃঢ়তার কারণেই তা ভন্ডুল হয়ে যায়। ভূট্টোর আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছিল। ভূট্টোর সেই ‘নটোরিয়াস’ তাজউদ্দিনই তাদের ‘মেইন প্রবলেম’ হয়ে দাঁড়ায়। অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া্র দরদরিয়া গ্রামে। মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান ও মেহেরুন্নেসার ৪র্থ সন্তান তাজউদ্দীন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দারুণ মেধাবী। পিতার কাছে আরবি শেখার মাধ্যমে লেখাপড়া শুরু করা তাজউদ্দীনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভুলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপরে কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুল, কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল পেরিয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)। এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ১৯৪৮ সালে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। একই সাথে কুরআনে হাফেজ হন।এরপরে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তাজউদ্দীন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের অনুসারী। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) এবং ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপরে ১৯৬৬, ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপরে ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

জাতীয় চার নেতা

একাত্তরের মার্চে দেশ যখন এক অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল; তখন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন যে পাকিস্তানীরা সেনা অভিযান চালালে তারা গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, যাতে বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে না পড়ে। সে কথামত ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আত্মগোপন করার জন্য তাজউদ্দীন ধানমণ্ডি ৩২ এ যান। কিন্তু তাজউদ্দীনের বহু অনুনয়ের পরেও বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তাজউদ্দীন একাই বাসায় ফিরে আসেন। ২৭শে মার্চ তিনি আমীর-উল-ইসলামের সাথে ভারতীয় সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কুষ্টিয়ার জীবন নগরের কাছে টুঙ্গি নামক স্থানে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন। সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় তাদের স্বাগত জানান ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আই জি গোলক মজুমদার।

৩রা এপ্রিল তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। তাজউদ্দীন ইন্দিরার কাছে সাহায্য চাইলেও দৃঢ়কণ্ঠে তাকে জানিয়ে দেন, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ! আমরাই দেশকে স্বাধীন করতে পারব।’

এরপরে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, যার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তাজউদ্দীন আহমদ। ১৭ এপ্রিল শপথ নেওয়ার পর থেকেই নানা প্রতিকূলতার স্বীকার হন তাজউদ্দীন। ঘরের শত্রু বিভীষণ হিসেবে দেখা দেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার আঁতাতের খবর পেয়ে তাজউদ্দীন তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন চাতুর্যতার সাথে। জাতিসংঘে মোশতাকের বদলে পাঠান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। একইভাবে সামলেছেন বিতর্কিত মুজিব বাহিনীকে।কিন্তু স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়ে তিনি ছিলেন আপোষহীন। মার্কিন সরকারের তরফ থেকে যখন তাকে বলা হয়েছিল, ‘স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবকে চাও? একটা পেলে আরেকটা পাবে না।’ তাজউদ্দীন তখন দ্ব্যার্থহীনভাবে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই।’

জাতির চরম দুর্দিনে ও জাতির পরিত্রাণে তাঁর প্রতিটি কর্মেই ছিল দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, ন্যায় ও সততার স্বাক্ষর। নিপুণ কৌশল ও দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য নয়টা মাস খেটে গেছেন যন্ত্রের মত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শর্ত ভেঙ্গে মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যরা পারিবারিক জীবনযাপন করলেও, তিনি তা করেননি। তার এত এত ত্যাগের ফল তিনি পান যখন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ও বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম

২২ ডিসেম্বর মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তাজউদ্দীন ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ওইদিন জলভরা চোখে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরা তাজউদ্দীন এর ছবিটা কবিতার মত সুন্দর। বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন সরকার ঘটিত হলে তাজউদ্দীন তাতে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। দায়িত্ব পেয়েই নিজের পোড়া বাড়ি মেরামত করার কাজে হাত না দিয়ে তিনি লেগে যান ‍যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় আগুনে পোড়া তাঁর পৈত্রিক ভিটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতা যখন বলেছিল – ‘আর চিন্তা কি, তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।’ তিনি তখন বলেছিলেন- ‘যতদিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না।’ সেই ভিটায় বাড়ি আর ওঠেনি।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের শাসকদের সাথে বৈঠক করেছেন মাথা উঁচু করে। সর্বদাই বাংলাদেশের সম্মান রেখেছেন সমুন্নত।

এমতাবস্থায়, দেশে-বিদেশে নানা স্বার্থান্বেষী মহল তাজউদ্দীন ও শেখ মুজিবের ‍বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে থাকে। শেখ মুজিব মানুষ চিনতে ভুল করেছিলেন। মোশতাকদের মত স্বাধীনতা বিরোধীদের প্ররোচণায় তিনি তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী তাজউদ্দীনকে ভুল বুঝেন। তাইতো ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগে বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীন সাবধান করে দিলেও বঙ্গবন্ধু তাতে কর্ণপাত করেননি। ফলে, ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিব। একইসাথে মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায় জাতীয় চার নেতার। ২২শে আগস্ট তাজউদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয়। দূরদর্শী তাজউদ্দীন বুঝেগিয়েছিলেন তার ভবিষ্যৎ পরিণতি। তাই তো যা্ওয়ার আগে স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, ‘ধরে নাও চিরদিনের জন্যই যাচ্ছি।’ তার আশঙ্কাই সত্যি হয়। ৩রা নভেম্বর তাঁর তিন সহকর্মীর সাথে কারাগারে গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জে প্রাণ হারান তাজউদ্দীন। জীবনাবসান ঘটে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য-সারথী, বাংলার অ্যাপোলো, বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের।

বঙ্গতাজ অমর্ত্যলোকে চলে গেলেন সকলের হৃদয়কে শূন্য করে। কিন্ত আসলেই কি তিনি আর নেই আমাদের মাঝে? যারা অসীম প্রেমময় ও সর্বজ্ঞানী স্রষ্টার আরাধনাকে রূপান্তরিত করেন মেহনতি ও নির্যাতিত মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির সংগ্রামে, তারা আশা-আলোর দিশারী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন এ জগতেও।

তথ্যসূত্র:

১.তাজউদ্দীনআহমদ: নেতা ও পিতা; শারমিন আহমদ

২.তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরী

৩.মুছে যাক আমার নাম, বেঁচে থাক বাংলাদেশ; আরিফ রহমান

Post Author: RK Desk

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *