সাধারণত ফাঁসি দেয়ার সময়টা হলো ভোররাত। কিন্তু বিশেষ কারণে সময়টা এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সন্ধ্যার পরে।
আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দীকে সেকথা জানানো হল বিকেল পাঁচটায়। জানানো হলো, বাকি অাছে আর মাত্র আড়াই ঘন্টা। শেষ কোনো ইচ্ছা থাকলে তা প্রকাশ করে ফেলতে।
বন্দী জবাবে বললেন, “আড়াই ঘণ্টা কেন ! এখনই নিয়ে চলো না ! আমরা তো প্রস্তুত হয়েই আছি !”
***
অন্ধকার কারাকক্ষে বসে লেনিনের জীবনী পড়ছেন তিনি।এমন সময় এলো কারারক্ষীর ডাক। যেতে হবে ফাঁসির মঞ্চে।
বন্দী শান্ত স্বরে বললেন, “দাঁড়ান। একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আর একজন বিপ্লবীর সাক্ষাৎকার চলছে।”
কিছুক্ষণ পরেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কারারক্ষীকে বললেন, “চলুন…..”
***
সন্ধ্যা সাতটা। তিনজনের একটি ছোট মিছিলের সাথে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছেন বন্দী। কণ্ঠে একটিই ধ্বনি-‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। ফাঁসিকাষ্ঠে উঠতে যাবেন, এমন সময় পাশে দাড়ানো ডেপুটি কমিশনারকে লক্ষ্য করে কৌতুকমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলেন, “You are very lucky”
ফাসির অাসামীর মুখে এমন কথা শুনে ডেপুটি কমিশনার অবাক হলেন। হতভম্ব গলায় বললেন, “What do you mean?”
বন্দী জবাব দিলেন, “আজ তুমি দেখতে পাবে, ভারতের বিপ্লবীরা আদর্শের জন্য কিভাবে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারে।”
অন্য দুজন আসামির সাথে ফাঁসির মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। জল্লাদ এসে মুখোশ পড়িয়ে দেবার আগে শেষবারের মতো গর্জে উঠলেন,
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
‘সাম্রাজ্যবাদ কা নাশ হো।’
***
১৯৩১ সালের তেইশ মার্চ। সন্ধ্যা সাতটা বেজে বাইশ মিনিট। ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো তিন বিপ্লবীর।
বেশ নিভৃতেই কাজটি সম্পন্ন হলেও ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারলো না, যাকে তারা আজ হত্যা করছে, তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে এমন এক আদর্শের সৃষ্টি করে গিয়েছেন, যার বিনাশ করা অসম্ভব।
এই মানুষটি আর কেউ নন, ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ ভগত সিং।
শৈশব ও বেড়ে ওঠা
ভগত সিংয়ের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর। পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়লাপুর জেলার বংগা গ্রামের কিশান সিং ও বিদ্যাবতীর সংসারে জন্ম তার। জাতে জাঠ এ পরিবারটি ছিলো রাজনীতি সচেতন। বাবা কিশান ও চাচা অজিত ছিলেন গদর পার্টির সদস্য।
ভগতের পড়ালেখার হাতেখড়ি ঘটে পরিবারেই। এরপর পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাকে ভর্তি করা হয় আর্যসমাজি বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে। চাইলে আরো ভালো স্কুলে পড়তে পারতেন তিনি। কিন্তু সেসব স্কুলে পড়লে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হতো। তাই সে পথে হাটেননি ভগত সিং।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়বার সময়কার ঘটনা। এক ভরদুপুরে খবর এলো, ভগত সিং স্কুল থেকে গায়েব। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা তার। সময়টা বড়ো খারাপ, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেছে মাত্র। পরিবারের সবার কপালে তাই দুশ্চিন্তার ভাঁজ, কোথায় গেলো ভগত?
অনেক রাতে দেখা মিললো ভগত এর। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে হেটে আসছেন তিনি, হাতে মুঠোভর্তি মাটি। এ মাটি শহীদের রক্ত মাখা মাটি, শতো মাইল পেরিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে এ মাটি কুড়িয়ে এনেছেন তিনি।
গান্ধীজী যখন অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করলেন, তখন কিশোর ভগত এর বয়স মাত্র চৌদ্দ। ওই বয়সেই তিনি মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হন। পুড়িয়ে ফেলেন সরকারি স্কুলের বই ও স্কুল ইউনিফর্ম।
বছর না পেরুতেই অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো গোটা ভারতজুড়ে। স্বাধীকার দাবীর মিছিলে যোগ দিলেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। আন্দোলনও এগোচ্ছিলো বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই। হঠাৎ ঘটে গেলো এক মর্মান্তিক ঘটনা।
১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরীচেরা গ্রামে চলছিলো কৃষকদের বিক্ষোভ। তাদের ওপর চললো পুলিশের নির্বিচারে গুলি। মারা গেলেন কয়েকজন কৃষক। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ঘেরাও হলো থানা, দেয়া হলো আগুন। পুড়ে মারা গেলো থানার ভিতরে থাকা ২২ জন পুলিশ। এ ঘটনার ফলে অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন গান্ধীজী।
অসহযোগ আন্দোলন থেমে গেলেও থামলেন না ভগত সিং। নজর দিলেন নিজের সম্প্রদায়ের দিকে। দেখলেন, সেসময়কার শিখ গুরুদ্বারগুলোতে যে আয় হয়, তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে পুরোহিতদের পকেটে।
এর প্রতিবাদ করলেন ভগত। গড়ে তুললেন গুরুদ্বার সংস্কার আন্দোলন। মাথায় রাখলেন বড়ো চুল, পড়লেন কালো পাগড়ি, কোমরে ঝোলালেন কৃপাণ।
নিজের লেখা ‘কেন আমি নাস্তিক?’ বইয়ে ভগত সিং বলেন,
‘সেই সময়ে আমি লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদে আমি আস্থা রাখতে পারিনি। তবু ঈশ্বরে আমার খুব বিশ্বাস ছিল।’
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হলেন পর ভগত সিং। এরপর ভর্তি হলেন ন্যাশনাল কলেজে। সেখানে দেখা পেলেন নানান বিষয়ের অধ্যাপকের, তাদের মুখ থেকে শুনলেন নানা অজানা তথ্য। বই পড়তে শুরু করলেন তিনি, জানলেন ইতালি, রাশিয়া আর আয়ারল্যান্ডের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস।
‘সব শেষ। ইহলোকে বা ‘পরলোকে’ পুরস্কৃত হবো এমন কোনো স্বার্থগত বাসনা বা অভিসন্ধি নেই। নিতান্ত নিঃস্বার্থভাবে আমি আমার দেশের মুক্তির জন্যে আমার এই জীবন উৎসর্গ করে গেলাম, কারণ, এ ছাড়া আমার আর কিছু দেবার ছিল না’
– ভগত সিং
পড়াশুনার পাশাপাশি শুরু করলেন থিয়েটার। নাম লেখালেন লাহোরের ন্যাশনাল ড্রামাটিক ক্লাবে। একে একে অভিনয় করলেন ‘সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত’, ‘রাণা প্রতাপ’, ‘ভারত দুর্দশা’ নাটক গুলোয়।
১৯২৩ সালে বি. এ কোর্সে ভর্তি হন ভগত। বাড়ি থেকে চাপ আসছে বারবার। এবার যে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তাকে! কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার পরিকল্পনা করেছেন যিনি, বিয়ের পিড়িতে বসা কি তার শোভা পায়?
তিনি বললেন,
“যদি এই পরাধীন ভারতেই বিবাহ করতে হয়, তাহলে মৃত্যুকেই আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম”
শুরু হলো বিপ্লবী জীবন
লাহোরের বিপ্লবী নেতা শচীন সান্যালের পরামর্শে চলে গেলেন কানপুর। সেখানে গিয়ে উঠলেন বিপ্লবী গণেশ শঙ্করের ‘প্রতাপ প্রেসে’। প্রতাপ প্রেস তখন গোটা উত্তরপ্রদেশের স্বাধীনতাকামীদের আড্ডাখানা। এখানেই বসে বিপ্লবের দীক্ষা নিলেন। এভাবেই ঘটলো তার বিপ্লবী জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা।
১৯২৫ সালে গঠিত হলো নওজোয়ান ভারত সভা। ভগত সিং হলেন সভার সেক্রেটারী। পাশাপাশি যোগ দিলেন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশনে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯২৫ সালে সালের ৮-৯ সেপ্টেম্বর দিল্লীর এক সভায় ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’-এর নামের সাথে সোস্যালিস্ট শব্দটি যুক্ত হলো।
১৯২৬ সালে লাহোরের এক বোমা হামলার সাথে জড়িয়ে গেলো ভগত সিংয়ের নাম। জারি হলো গ্রেফতারী পরোয়ানা, ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে। ৫ মাস বাদে ষাট হাজার রুপি মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেন তিনি।
‘আত্মবিশ্বাসকে প্রায়শ আত্মম্ভরিতা বলে ভুল করা হয়। এটা যেমন দুঃখজনক, তেমনি শোচনীয়। কিন্তু কিছু করার নেই!’
– ভগত সিং
১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর। সাইমন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্টের প্রতিবাদে লাহোরে আয়োজন করা হয়েছে একটি পথযাত্রার। নীরব অহিংস পথযাত্রায় বেদম লাঠি চার্জ শুরু করলো পুলিশ। গুরুতর আঘাত পেলেন পথযাত্রার নেতৃত্বে থাকা লালা লাজপত রায়। একপর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি।
এ ঘটনা ভগত সিংয়ের মনে দাগ কাটলো। মরিয়া হয়ে উঠলেন প্রতিশোধ নেবার জন্য। লাঠিচার্জে নেতৃত্বদানকারী পুলিশ প্রধান স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা আটতে শুরু করলেন সহযোদ্ধা রাজগুরু, সুখদেব ও জয় গোপালকে নিয়ে।
সহকর্মী জয় গোপালের ওপর দায়িত্ব পড়লো স্কটকে সনাক্ত করার। তিনি ডেপুটি পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্ট জন পি. সন্ডার্সকে দেখে পুলিশ প্রধান স্কটকে ভেবে ভগত সিং-কে গুলি করার সংকেত দিয়ে ফেললেন। ফলে ভগত সিংয়ের চালানো গুলিতে মারা পড়লেন জন পি. সন্ডার্স।
গা ঢাকা দিলেন ভগত সিং। পুলিশকে ফাঁকি দিতে চুল-দাড়ি কামিয়ে চলে আসলেন কলকাতায়। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন কিছু করতে হবে যা ব্রিটিশ রাজের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে পারে।
যেভাবে ঘটলো ইতি
১৯২৯ সালে এলো তেমন একটি সুযোগ। এপ্রিলের ৮ তারিখ এসেম্বলি ভবনের করিডরে বোমা ছুড়লেন ভগত এবং তার সাথীরা, নিছক ভয় সৃষ্টি করতেই। তাতে কাজও হলো। কিন্তু ধরা পড়লেন তিনি, সুখদেব এবং রাজগুরু।
কারাগারে পাঠানো হলো ভগতকে। সেখানে ইংরেজ ও দেশীয় কয়েদীদের মধ্যকার বৈষম্য ব্যাথিত করে তুললো তাকে, শুরু করলেন অনশন। ১১৬ দিন পর যখন সে অনশন থামলো, তখন তারিখটা ৫ অক্টোবর।
এর আগেই ১ মে বিচারের জন্য গঠন করা হয়েছিলো বিশেষ আদালত। ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর বিচারপতি কোল্ডস্ট্রিম, হাইডার এবং হিলটনের পুতুল আদালত ফাঁসির রায় শোনালেন তিন আসামীকে।
এর পরের কাহিনী সবারই জানা। চিরদিনের মতো চোখ বুজলেন ভগত সিং, কিন্তু জাগিয়ে গেলেন অসংখ্য তরুণকে। যাদের হাত ধরে এলো স্বাধীনতা, এলো স্বাধীকার।
তিনি বলে গেছেন,
“আমি জানি যে-মুহূর্তে ফাঁসির দড়ি আমার গলায় এঁটে বসবে, পায়ের তলা থেকে পাটাতন সরিয়ে নেওয়া হবে, সেই হবে আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত, আমার জীবনের সর্বশেষ ক্ষণ। ‘আমি’ বা আমার ‘আত্মা’- সেখানেই চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ! আর কিছু নেই। এক অতি সংক্ষিপ্ত সংগ্রামী জীবনের কীর্তিহীন, গৌরবহীন, মাহাত্ম্যহীন পরিসমাপ্তি! যদি এইভাবে সাহসের সঙ্গে মেনে নিতে পারি- তবে সেটিই হবে আমার জীবনের সর্বোত্তম পুরস্কার।”