অভিনয় জগতের সাথে জড়িত সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে যে, সব থেকে কঠিন কাজ হচ্ছে দর্শকদের নিজের অভিনয় দিয়ে হাসানো। আর গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তরের দশকে এই সবথেকে কঠিন কাজটি ব্রিটেনে করে বেরিয়েছিলেন আমাদের পুরান ঢাকার এক সন্তান, যার নাম দিনো শাফিক। ‘Mind Your Language’-এর পাকিস্তানি আলী নাদিম সেজে পৌছে গিয়েছিলেন তিনি ব্রিটেনের প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাংলাদেশে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শিক্ষাজীবন শেষ করে দূর বিভুইয়ে পাড়ি দিয়ে সেখানে শুধুমাত্র নিজের কলার বদৌলতে বনে যান তারকা। আর জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরব আজ।
জন্মঃ
১৯৩০ সালের ১০ই মার্চ ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পূর্ব বাংলার ঢাকায় তার জন্ম। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় গোলাম ডি. শাফিক। তার বাবা গোলাম মেরাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন ‘চিনি প্রযুক্তিবিদ’। ঢাকাতেই স্কুল, কলেজের পাঠ চুকে তিনি ভর্তি হোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সেখান থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
ব্রিটেনযাত্রাঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই শাফিক আকৃষ্ট হয়ে যান থিয়েটারে। ঢাকার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অখ্যাত থিয়েটারে নিজের অভিনয় কলার চর্চা করতে থাকেন শাফিক। কিন্তু শাফিকের এই অভিনয়প্রীতি সুনজরে দেখে নি তার পরিবার। শাফিক বুঝতে পারেন যে দেশে থাকলে তার জন্য অভিনয় করা সহজ হবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ব্রিটেনে চলে যাওয়ার।
১৯৫৮ সালে ব্রিটেনে গিয়ে তিনি ভর্তি হয়ে যান লন্ডনের ‘Guidehall School of Music and Drama‘-তে। আজীবন বাংলাদেশে থাকা শাফিকের জন্য নতুন দেশে টিকে থাকার লড়াই কোনোভাবেই সহজ ছিল না।কিন্তু তার প্রতিভার কাছে সব বাধা তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়।
অভিনয় জীবনের সূচনাঃ
ব্রিটেনে শাফিকের জন্য অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া যথেষ্ট দুরহ ছিল। দীর্ঘদিন পরিশ্রম করার পর অবশেষে ব্রিটেনে যাওয়ার প্রায় নয় বছরের মাথায় শাফিকের কাছে প্রথম সুযোগ আসে চলচ্চিত্র জগতে অভিনয় করার। ১৯৬৭ সালে ‘The Long Dual’ চলচ্চিত্রে আকবর নামের একটি ছোট চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। সেখান থেকেই তার সৌভাগ্যের চাকা সচল হয়ে।
সেই বছরেই টেলিভিশনে ‘Softly Softly’ নাটকের ২টি পর্বে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান শাফিক। তারপর থেকে একযোগে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে অভিনয় করতে থাকেন।
নিয়মিত অভিনয় করতে থাকলেও ঠিক সে অর্থে জনপ্রিয় হতে পারছিলেন না তিনি। ছোট খাট চরিত্রে অভিনয় করার কারণে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তার অপেক্ষার কাল আর খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি। তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় দুটি নাটকে অভিনয় করে।
‘It Ain’t Half Hot Mum’:
১৯৭৪ থেকে বিবিসিতে প্রচারিত হয় এই ধারাবাহিকটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ে ভারতের বোম্বেতে ব্রিটিশ সৈনিকদের নিয়ে গড়া একটি কনসার্ট পার্টি, যাদের কাজ হচ্ছে সৈনিকদের মনোবল গানের মাধ্যমে চাঙ্গা রাখা। সেখানে এক চা-বিক্রেতা মোহাম্মদের চরিত্রে দেখা যায় শাফিককে। এখানে অভিনয়ের পাশাপাশি একাধিক গানও গেতে দেখা যায় তাকে। সেখানে প্রথমবারের মত কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তার দক্ষতা প্রকাশ পায়। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এই সিরিজটি সচল থাকে।
‘Mind Your Language’:
১৯৭৭ সালে তিনি সুযোগ পেয়ে যান লন্ডনের আইটিভির সিটকম ‘Mind Your Language‘-এ। একদল বিদেশি অভিবাসীর লন্ডনের এক স্কুলে ইংরেজি ভাষা শেখার ক্লাসকে ঘিরে এই সিটকমের গল্পটি। এখানে পাকিস্তানের লাহোর থেকে আসা এক অভিবাসী আলি নাদিম-এর চরিত্রে অভিনয় করেন শাফিক। তিন বছর চলা ঐ সিটকম প্রচুর জনপ্রিয় হয় ব্রিটেনে। স্যাটেলাইট সম্প্রচারের কারণে ব্রিটেনের বাইরেও একাধিক দেশে লোকপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চলে এই সিটকম।
নাটকে আলাদা করে নজর কাড়ে দিনো শাফিকের আলি নাদিম। তার সবসময় পড়ে থাকা জিন্নাহ টুপি, ভারতীয় শিখ রণজিৎ সিং-এর সাথে তার বিতন্ডা আর তার নিখুঁত কমিক টাইমিং তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। এই সিটকমটি এখনো একটি কাল্ট ক্ল্যাসিক বলে মানা হয়।
অকাল প্রয়াণঃ
শাফিক একজন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর একের পর এক কাজের সুযোগ তার কাছে আসতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে, Hazell, Minder, Into the Labyrinth (টেলিভিশন); Young Winston, Highroad to China (চলচ্চিত্র); Dick Wittington And His Cat, Gandhi(থিয়েটার)।
কিন্তু এরই মাঝে লন্ডনে নিজ বাসভবনে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে ১০ মার্চ, ১৯৮৪ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর এতকাল পরেও ব্রিটেনে এক বাংলাদেশির সফলতার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে, তার অভিনয় দেখে আনন্দ পাওয়া দর্শকদের হাসির মাঝে বেঁচে আছেন তিনি।