বৈচিত্রময় বাঙালি সংস্কৃতির এক ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ হচ্ছে যাত্রাপালা। শত শত বছর ধরে যাত্রা গ্রাম বাংলার মানুষকে তার নিজের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সাথে পরিচিত করিয়ে আসছে। উপনিবেশিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে একান্তই আমাদের নিজস্ব শিল্প হিসেবে টিকে রয়েছে যাত্রাপালা। যদিও আমাদের অবহেলা ও অবজ্ঞায় এক কালের প্রতাপশালী এই শিল্প এখন মুমূর্ষু অবস্থায়।
বাংলা লোকনাট্যের একটি জনপ্রিয় শাখা হচ্ছে যাত্রা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় পবিত্র কোনো স্থানে ভ্রমণ করাকে যাত্রা বলে থাকে। আর যাত্রা যখন প্রথম শুরু হয় তখন ভগবানের নানান কীর্তি সেখানে গীতিকাব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হত। এখান থেকেই যাত্রা নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
বাংলা বিশ্বকোষ প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু যাত্রাকে নিম্নোক্তভাবে সঙ্গায়িত করেছেন,
‘অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানাসাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদী সহকারে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত। গীতবাদ্যাদীযোগে ঐ সকল লীলোৎসব– প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে– তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত।’
সূচনাকালঃ
অষ্টম শতাব্দী থেকেই বাংলায় পালা গানের প্রচলন ছিল। তখন সনাতন ধর্মের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি যেমন, শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী ইত্যাদি অভিনয়ের মাধ্যমে দেখানো হত। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর শ্রী কৃষ্ণের বিভিন্ন গল্প যেমন, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, কৃষ্ণের বাল্যকাল, মা যশোদার সঙ্গে কৃষ্ণর বাল্যক্রীড়া, কৃষ্ণের কংসবধ, মথুরা জয় ইত্যাদি কাহিনি অভিনয় ও গানের মাধ্যমে দর্শকদের পরিবেশন করা শুরু হয়। কৃষ্ণকে নিয়ে অভিনীত এসকল নাটককেই পরবর্তীতে কৃষ্ণযাত্রা বলে অভিহিত করা হয়। সেই সময়ই অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দির ১ম দশকেই যাত্রাপালার সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। ১৫০৯ সালে অভিনীত কৃষ্ণযাত্রা ‘রুক্মিণী-হরণ’কেই ১ম যাত্রাপালা বলা হয়। সেই যাত্রায় রক্সিণী চরিত্রে শ্রী চৈতন্যদেব নিজেই অভিনয় করেছিলেন। যাত্রার উদ্ভব হয়ে গেলেও তার প্রসার বাড়তে আরো প্রায় ২৫০ বছর লেগে যায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে যাত্রাপালা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুবল দাস, পরমানন্দ অধিকারী, শিশুরাম ছিলেন সেইসময়ের যাত্রার পুরোধা ব্যক্তি। তারপরের শতকে এসে মহাভারত, রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলার পাশাপাশি বিভিন্ন লোক কথা ও প্রেম কাহিনী যেমন, বিদ্যাসুন্দর, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, বেহুলা-লখিন্দর, মা মনসা, লক্ষ্মীর মহিমা, কমলাবতী রানী ইত্যাদির উপর নির্মিত হয় যাত্রাপালা। সেই শতকে মতিলাল রায় ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়-এর যাত্রাদল বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যাত্রাঃ
যাত্রার বিষয়বস্তুতে প্রথম বড় পরিবর্তন আসে বিংশ শতাব্দীতে। তখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য এবং মানুষের মাঝে দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যাত্রাপালাকে হাতিয়ার বানানো হয়। এই কাজে সবথেকে বড় ভূমিকা ছিল বাংলার ‘চারণ কবি’ মুকুন্দ দাস-এর।
বরিশালের কবি মুকুন্দ দাসের নিজস্ব যাত্রা দল ছিল। বিপ্লবী অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে এসে তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সোচ্চার হন তিনি। অশ্বিনীকুমার দত্তের অনুপ্রেরণায় রচনা করেন যাত্রা ‘মাতৃপূজা’। দুর্গাপূজার সপ্তমীতে এই যাত্রা প্রথমবারের মত অভিনীত হয়। তারপর আরো অনেকবার বিভিন্ন জায়গায় নিজের যাত্রাদলের সাথে যাত্রাটি মঞ্চস্থ করেন মুকুন্দ দাস। যাত্রাটিতে ইংরেজ সরকারের সমালোচনা করা হয় এবং তাদের অনাচারের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। ‘মাতৃপূজা’ থেকেই ‘স্বদেশী যাত্রা’ নামে এক নতুন ধরনের যাত্রাপালার সূচনা হয়।
‘আমি দশ হাজার প্রাণ যদি পেতাম
তবে ফিরিঙ্গি বণিকের গৌরব রবি
অতলে জলে ডুবিয়ে দিতাম।’
ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার দায়ে ‘মাতৃপূজা’-কে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং মুকুন্দ দাসকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
মুকুন্দ দাসকে অনুসরণ করে আরো অনেকে স্বদেশী যাত্রা নির্মাণ করা শুরু করে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা, ঈশা খাঁ, প্রতাপচন্দ্র, বারো ভুঁইয়া, ক্ষুদিরাম বসু ও অন্যান্য বিপ্লবীর কাহিনী নিয়েও যাত্রাভিনয় শুরু হয়। বাঙ্গালিদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বাংলার বীরদের বীরত্বগাথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া হয় এসকল যাত্রার মাধ্যমে। তার পাশাপাশি ‘স্বদেশী যাত্রা’-তে সমাজ ও দেশ সংস্কারের কথা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইত্যাদি প্রচার করা হত। এভাবেই ইংরেজ শাসনের শেষার্ধে যাত্রাপালা বাংলায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়।
পাকিস্তান আমলে যাত্রাঃ
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকেই যাত্রা শিল্পের পতন শুরু হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য অনেক যাত্রা শিল্পী ও পালা দল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতে চলে যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি লোকসংস্কৃতিকে কখনোই তার প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। ধর্মের বিভাজনের মাধ্যমে সৃষ্ট এই নতুন রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। উগ্রপন্থীরা যাত্রাপালাকে ইসলাম পরিপন্থী বলে চিহ্নিত করে। দেশের নানাপ্রান্তে যাত্রাপালার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা হয়। সেইসময়ে যাত্রা করার পূর্বে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার রীতি শুরু হয়। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নির্দেশে বন্ধ করা হয় ‘রুপবান’ যাত্রা। পাকিস্তান আমলে যাত্রাশিল্পকে খুব সংকটময় সময় পার করতে হয়।
স্বাধীনতার পরবর্তী প্রেক্ষাপট ও বর্তমান অবস্থাঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয় হয়। সেই সাথে যাত্রা দলগুলো আবারো প্রবল উৎসাহের সাথে নতুন যাত্রা নির্মাণ করা শুরু করে। স্বাধীনতার পর থেকে পরবর্তী এক দশকে বাংলাদেশে অনেকগুলো উৎকৃষ্ট মানের যাত্রাপালা নির্মিত হয়। ‘বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন’(১৯৭৩), ‘লেনিন’(১৯৭৪), ‘হিটলার’(১৯৭৫), ‘জানোয়ার’(১৯৭৬), ‘নটি বিনোদিনী’(১৯৭৬), ‘মা-মাটি-মানুষ’(১৯৭৯), ‘বিদ্রোহী নজরুল’(১৯৭৬), ‘ক্লিওপেট্রা’(১৯৮০), ‘চিড়িয়াখানা’(১৯৮১) ইত্যাদি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু ৮০-র দশক থেকেই যাত্রা শিল্পের চূড়ান্ত অবক্ষয় শুরু হয়। যাত্রাপালার নামে কিছু যাত্রা দল মঞ্চে অশ্লীল নৃত্য দেখানো শুরু করে। তার পাশাপাশি চলতে থাকে জুয়ার আসর। কিছু কুরুচিপূর্ণ ব্যবসায়ীর হাতে কলুষিত হয়ে পড়ে বাঙালি লোকসংস্কৃতির এই অমূল্য সম্পদ।
যাত্রার নামে এসব কুরুচিপূর্ণ ও অপরাধমূলক কার্যক্রম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯১ সালের ৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় থেকে সারাদেশে যাত্রা প্রদর্শন বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়।
সরকারের এই ঘোষণায় যাত্রা শিল্পী ও কলাকুশলীদের উপর খড়গ নেমে আসে। ঘোষণাটি দেয়ার সময়ে বাংলাদেশে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত যাত্রা দল ছিল ২১০টি। আর্থিক সংকটের কারণে এর অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে পড়ে।
তারপর থেকেই বাংলাদেশের যাত্রার দুরবস্থার সূচনা হয়। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত যাত্রাশিল্পের এই অচলাবস্থার কিছুটা অবসান ঘটলেও, বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প এখন পর্যন্ত অশ্লীলতার কালো ছায়া থেকে মুক্তি পায়নি।
২০১২ সালে সরকার যাত্রার নীতিমালা নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে নতুন করে ৮৮টি যাত্রা দল নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু এসকল দলের বেশিরভাগই অনুষ্ঠান মঞ্চায়ন করতে পারছে না। আর্থিক অসঙ্গতির পাশাপাশি সব জায়গায় যাত্রা মঞ্চায়নে প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়া তাদের অক্ষমতার পেছনের কারণ। এখনো কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আসর চালিয়ে যাচ্ছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত যাত্রা শিল্পীরা। যাত্রা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
আমাদের সমাজের লোকেরা এখন যাত্রাপালাকে অশ্লীল, উদ্ভট ও শুধুমাত্র নিম্নশ্রেণীর মানুষের বিনোদনের মাধ্যম বলে মনে করে। কিন্তু পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে যে যাত্রাপালা তার সূচনালগ্ন থেকেই সমাজের সকল শ্রেণির লোকদের বিনোদিত করে এসেছে। সাধারণ লোকেরা একসাথে মাঠে জমায়েত হয়ে যে যাত্রাটি দেখত ঠিক সেই যাত্রাটি রাজা, জমিদারেরা নিজেদের জলসাঘরে বসে পরিবারের সাথে উপভোগ করতেন।
প্রথমদিকে যাত্রা শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে হলেও তারপর তার পরিধি অনেক বেড়ে যায়। যাত্রাপালা সাধারণ বাঙ্গালিদের তাদের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করে দেয়। গ্রামের গরীব, নিরক্ষর জনগোষ্ঠী যাত্রাপালা থেকে জানতে পেরেছে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের করুণ কাহিনি, জেনেছে বিদেশ বিভূঁইয়ে যেয়ে বাংলার মধুসূদণের মাইকেল বনে যাওয়ার কাহিনি, জেনেছে তিতুমীর, মীর কাসিমদের বীরত্বগাঁথা। বিনোদনের ছলে যাত্রা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বুনেছে স্বাধীনতার চেতনা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি, জাগিয়ে তোলা হয়েছে জাতীয়তাবাদের চেতনা।
বর্তমানের মৃতপ্রায় এই শিল্প একসময় ছিল গ্রাম বাংলার বিনোদনের অন্যতম বড় উৎস। আশ্বিন-চৈত্র, এই সাত মাসে তখন দেশের আনাচে কানাচে বসত যাত্রাপালার আসর। বিশেষ করে দুর্গাপূজার উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ছিল যাত্রাপালা। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত চলত এই যাত্রাভিনয়। আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষেরা এসে একসাথে উপভোগ করত যাত্রাপালা। শিশু থেকে শুরু করে প্রৌঢ়, সকল বয়সের মানুষ উপস্থিত থাকত যাত্রার আসরে। গ্রামের মহিলারাও তাদের স্বামী ও সন্তানদের সাথে আসতেন যাত্রা দেখতে। কিন্তু যাত্রার সেই সোনালি দিন এখন অতীত।
বাঙালির লোকসংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব উপাদান হচ্ছে এই যাত্রাপালা। ইন্টারনেটের যুগে এসে অনেকের কাছে যাত্রার মঞ্চ বড্ড সেকেলে ঠেকতে পারে। তারপরও বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব উপাদান হিসেবে যাত্রাপালার সংরক্ষণ করা খুব প্রয়োজন। নাহলে নিজেদের জাতিগত স্বকীয়তার আরেকটি উপাদান খুব শীঘ্রই আমরা হারিয়ে