কেউ যদি ভারতের সবগুলো কাগুজে নোট হাতে নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তবে তিনি একটি ব্যাপার খেয়াল করতে বাধ্য। তা হলো, সেদেশের প্রত্যেকটি ব্যাংকনোটেই একজন চশমা পরিহিত সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ উপস্থিত। মানুষটির ঠোঁটে লেগে অাছে এক চিলতে হাসি, যেটি তার সরল অভিব্যক্তির পরিচয় বহন করে।
মানুষটি অার কেউ নন, ভারতের অবিসংবাদিত জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী। কারো কাছে তিনি ‘গান্ধীজী’, অাবার কারো কাছে তিনি ‘বাপু’। এভাবেই তিনি অাসন গেড়েছিলেন এ উপমহাদেশের মানুষের মানসপটে।
পরিচয়, শৈশব ও শিক্ষাদীক্ষা:
মহাত্মা গান্ধীর পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তাঁর জন্ম ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর, পোরবন্দরের এক হিন্দু বৈশ্য পরিবারে। বাবা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান (প্রধানমন্ত্রী)। মা পুতলিবাই ছিলেন করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী। উল্লেখ্য যে গান্ধীর বাবার আগের তিনজন স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। গুজরাটের জৈন পরিবেশে গান্ধী ছোটবেলা থেকেই অহিংসা ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবাই মাখাঞ্জীকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের সংসারে চারটি পুত্র ছিল।
পোরবন্দর ও রাজকোটে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে গান্ধী গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ১৮ বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন যান। ১৮৯১ সালে গান্ধী ব্যারিষ্টারি পাস করে ভারতে ফেরত অাসেন। এরপর বোম্বাই আদালতে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
অাফ্রিকা সফর:
১৮৯৩ সালের জুন মাসে তিনি এক বছরের জন্য Dada Abdulla & Co. নামক একটি কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে যান। এরপর প্রায় ২১ বৎসর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতে কাটান।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফর গান্ধীর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেখানে তিনি ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করেন। একবার ডারবানের আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে পাগড়ি খুলতে বলায় গান্ধী আদালত থেকে ক্ষোভে বেরিয়ে পড়েন। অারেকবার ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় প্রথম শ্রেণীর টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে তৃতীয় শ্রেণীতে যেতে বাধ্য করা হয়। মূলত এই ঘটনাগুলোকে তার অান্দোলনের ভিত রচনা করে।
১৯০৬ সালে ট্রান্সভাল সরকার ভারতীয়দের নিবন্ধনে বাধ্য করানোর জন্য একটি আইন প্রনয়ন করে। গান্ধী এই কালা-কানুনের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ এক অান্দোলন গড়ে তোলেন, যার নাম সত্যাগ্রহ। সাত বছর চলা এ আন্দোলনের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার জেনারেল ইয়ান ক্রিশ্চিয়ান স্মুট গান্ধীর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হন। এর মাধ্যমেই দক্ষিণ অাফ্রিকায় তার আদর্শ প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর ১৯১৫ সালে তিনি ভারতে ফেরত অাসেন।
সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ অান্দোলনের ডাক:
১৯১৯ সালে গান্ধী ব্রিটিশ প্রবর্তিত বিতর্কিত ‘রাউলাট বিল’ বাতিলে সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। ১৩ই এপ্রিল তারিখে জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধীজী সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করে ৩ দিনের উপবাস করেন। নভেম্বর মাসে দিল্লীতে নিখিল ভারত খিলাফত কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন গান্ধীজী।
১৯২০ সালে গান্ধী খিলাফত অান্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অান্দোলনের প্রধান কর্মসূচি ছিল সাথে শান্তিপূর্ণ অসহযোগিতা এবং বিদেশী পণ্য বয়কট। এর পরের বছর গান্ধীকে কংগ্রেসের নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয় ও তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেসের নতুন সংবিধান রচিত হয়।
১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে গুজরাটের বরদৌলিতে সত্যাগ্রহ কর্মসূচী শুরু হয়। কিন্তু ৫ই ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের চৌরিচোরাতে উত্তেজিত জনতার দেয়া অাগুনে ২২ জন পুলিশ মারা যায়। এই সহিংস ঘটনার দায়ভার নিয়ে গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন স্থগিত করেন। ১৯২২ সালের ১০ মার্চ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিচারে ছয় বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
সরকার কর্তৃক লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপের প্রতিবাদে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গান্ধী এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পর্যন্ত ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক পদযাত্রার অায়োজন করেন। একে লবণ সত্যাগ্রহ বলে অভিহিত করা হয়। লক্ষাধিক ভারতীয়কে সাথে নিয়ে ৬ এপ্রিল তিনি ডান্ডি পৌছান। ৫ মে তারিখে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিনা বিচারে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর ফলে সারা দেশে বিক্ষোভ জন্ম নেয়। ১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারিতে তিনি বিনা শর্তে মুক্তি পান।
১৯৪২ সালে ক্রিপ্স মিশন ব্রিটিশ শাসন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসে। কিন্তু মিশনের প্রস্তাব দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং প্রথম প্লেনে ক্রিপ্সকে দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মে মাস থেকে শুরু হয়, ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে নোয়াখালি জেলায় এবং বিহারে এই দাঙ্গা মারাত্মক রূপ লাভ করে। অক্টোবর মাসে নোয়াখালিতে তিনি কর্মস্থল স্থাপন করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ভিতর মৈত্রী-স্থাপনের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগষ্ট জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান।
তবে এতে করে গান্ধীর ইচ্ছার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। কেননা গান্ধী একটি অখন্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে সকল ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু ধর্মীয় বৈচিত্রের ভিত্তিতে করা এই বিভাজনে গান্ধী মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার মতে এই বিভাজন ছিল ইংরেজদের একটি কূটচাল এর অংশ, যার উদ্দেশ্য এদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা।
দর্শন ও শিক্ষা:
ব্যক্তিগত জীবনে একজন নীতিবান হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও মন-মানসিকতায় গান্ধী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। এ কারণেই তিনি ভারত বিভাগ আন্দোলনের সময় মুসলমান এবং অন্য ধর্মালম্বী নেতাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গান্ধীর মতে ভালোবাসা এবং সম্প্রীতি দিয়ে যে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব তা অন্য কোন যুদ্ধ বা বিপ্লব দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। গান্ধী মূলত উদ্দেশ্যের চেয়ে পন্থার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর দর্শন এবং চিন্তা-ধারা বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। জীবনের একটি বিরাট সময় গান্ধী ব্রহ্মচারী হিসেবে কাটিয়েছেন। যার ফলে তার ব্যক্তিগত জীবনে অহিংসা নীতির প্রয়োগ দেখা যায়।
মৃত্যু:
গান্ধীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারত স্বাধীন হলেও গান্ধী বেশিদিন তা দেখে যেতে পারেননি। ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮, এক শীতের বিকেলে গান্ধী যাচ্ছিলেন দিল্লির বিড়লা হাউসের সর্বধর্ম প্রার্থনাসভায়৷ ঠিক তখনই বিড়লা হাউসের বাগানে নাথুরাম বিনায়ক গডসে নামক একজন হিন্দু মৌলবাদী উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ করে গান্ধীকে হত্যা করে।
গান্ধীর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর দেহভস্মের কিছু অংশ বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রধান নদী যেমন— নীল নদ, ভোলগা, টেমস প্রভৃতিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এরপর অবশিষ্টাংশ সেলফ রিয়ালাইজেশন ফেলোশিপ লেক স্রাইনের মহাত্মা গান্ধী বিশ্বশান্তি সৌধে একটি হাজার বছরের পুরনো চৈনিক পাথরের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়।
গান্ধী তার অতি শান্তিকামী নীতির জন্য কিছু কিছু মহলে সমালোচিত হলেও তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই তিনি পেয়েছেন ভারতের জাতীর পিতার সম্মান। পেয়েছেন ‘মহাত্মা’ উপাধী। এ মহান মানুষটি বলে গেছেন,
জীবন নশ্বর, তাকে অমর করতে শেখো।