১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপের ২য় আসরে প্রথমবারের মত অংশগ্রহণের সুযোগ পায় বাংলাদেশ। তারপর থেকে মোট ১৪ বার টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টুর্নামেন্টটি জিততে পারেনি। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য ২০১২ ও ২০১৬ আসরের রানার্সআপ হওয়া। সাম্প্রতিক কিছু বছরে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সাফল্যের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, একইভাবে তীরে এসে তরী ডুবেছে বেশ কয়েকবার। জয়ের নিকটে যেয়ে হার মেনে নেয়ার ৩টি হৃদয়বিদারক পরাজয়ের স্মৃতি তুলে ধরছি আজ।
১.ভারত বনাম বাংলাদেশ ২০১৬ এশিয়া কাপ ফাইনালঃ
সর্বশেষ এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ছিল আয়োজক দেশ। ২০১৬ সালের আসরটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটে, যে ফরম্যাটে বাংলাদেশ বরাবরই দুর্বল। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের কাছে ৪৫ রানে হেরে খারাপ সূচনা হয় স্বাগতিকদের। কিন্তু আরব আমিরাত এবং শ্রীলঙ্কাকে দাপটের সাথে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ফিরে আসে। তারপর পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ওভারের ৫ উইকেটের জয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে ২য়বারের মত পৌছে যায় এশিয়া কাপের ফাইনালে।
ফাইনালের প্রতিপক্ষ ছিল টুর্নামেন্টের অপরাজিত দল ভারত। ম্যাচ শুরুর আগে বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচটি ১৫ ওভারের হয়ে যায়। টস জিতে ভারত বাংলাদেশকে প্রথমে ব্যাটিং-এ পাঠায়। ওপেনিং জুটি তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার বাংলাদেশকে ঝড়ো সূচনা দিতে ব্যর্থ হয়। তামিম ১৭ বলে ১৩ এবং সৌম্য ৯ বলে ১৪ করে আউট হয়ে যান। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমান ২৯ বল খেলে ৩২ রানে অপরাজিত থাকেন। কিন্তু ফাইনালে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ২ চার ও ২ ছয়ে মাত্র ১৩ বলে অপরাজিত ৩৩ রান করে বাংলাদেশের স্কোরকে ১২০ রানে নিয়ে যান তিনি।
জবাবে ইনিংসের ২য় ওভারেই ওপেনার রোহিত শর্মাকে আউট করে দেন আল-আমিন। কিন্তু তারপর শিখর ধাওয়ান ও ভিরাট কোহলি মিলে ভারতের ইনিংসকে উদ্ধার করেন। তাদের ৯৪ রানের পার্টনারশিপ ভারতকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। ১৩তম ওভারে তাসকিনের বলে ধাওয়ান আউট হলে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ আসে ম্যাচে ফিরে আসার।
শেষ ২ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ১৯ রান। নিজের প্রথম ২ ওভারে ১০ রানের বিনিময়ে ১ উইকেট নেয়া আল-আমিনকে ১৪তম ওভার করার দায়িত্ব দেয়া হয়। স্ট্রাইকে নতুন ব্যাটসম্যান ধোনি। একটি টাইট ওভার অথবা ১-২টি উইকেট ম্যাচটিকে বাংলাদেশের পক্ষে ঘুরিয়ে দিতে পারত। কিন্তু ভারতের অধিনায়ক ধোনি প্রথম বলেই মেরে দেন এক বিশাল ছক্কা। ওভারের ৩য় বলে কোহলির ব্যাট থেকে আসে ৩ রান। ভারতের তখন প্রয়োজন ৯ বলে ৯ রান। ধোনি ম্যাচটিকে শেষ ওভারের নাটকে পৌছতেই দেননি। ওভারের ৪র্থ ও ৫ম বলে যথাক্রমে চার ও ছয় মেরে খেলাটির সমাপ্তি টনে দেন ধোনি। ভারত ৮ উইকেট ও ৭ বল বাকি থাকতেই ম্যাচটি জিতে নেয়। আর বাংলাদেশকে আবারো রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
২.পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ ২০১৪ এশিয়া কাপঃ
২০১৪ সাল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ছিল এক শোচনীয় বছর। ঘরের মাঠে ৩ ফরম্যাটেই শ্রীলঙ্কার কাছে নাস্তানাবুদ হয় বাংলাদেশ। সেই বছরের এশিয়া কাপের স্বাগতিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ টুর্নামেন্টের ৪টি ম্যাচেই পরাজিত হয়। এই পরাজয়গুলোর মধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ওভারে হেরে যাওয়া ম্যাচটি ছিল সবথেকে বেশি পীড়াদায়ক।
প্রথমে ব্যাটিং করে এনামুল হকের শতক, ইমরুল, মুমিনুল, মুশফিকের অর্ধ শতক এবং ইনিংসের শেষদিকে সাকিব আল হাসানের ১৬ বলে ৪৪ রানের ঝড়ো ইনিংসের উপর ভর করে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩২৭ রানের বিশাল টার্গেট দাঁড়া করায়।
জবাবে ওপেনার আহমেদ শেহজাদ-এর শতক এবং মো. হাফিজের অর্ধ শতকে পাকিস্তান শুভ সূচনা করে। কিন্তু তারপর দ্রুত পাকিস্তানের ৪টি উইকেট পড়ে গেলে বাংলাদেশ আবারো চালকের আসনে চলে আসে। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ফাওয়াদ আলম ৭০ বলে ৭৪ করে ম্যাচে পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায় মূলত শাহিদ আফ্রিদির ঝড়ো ইনিংসের কারণে। ৭টি ছক্কা ও ২টি চারের মারে আফ্রিদি মাত্র ২৫ বলে ৫৯ রানের ইনিংস ম্যাচটিকে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়ে যায়। ৪৭তম ওভারে সাকিব আল হাসানের থ্রোতে আফ্রিদি রান আউট হলে, বাকি কাজটুকু ফাওয়াদ আলম ও উমর আকমল করে দেন। উমর আকমলের চারে এক বল হাতে রেখেই ম্যাচ জিতে যায় পাকিস্তান। ঐতিহাসিক জয়ের আশায় থাকা বাংলাদেশী ক্রিকেট ভক্তদের দিন শেষ হয় হতাশায়।
৩.পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালঃ
২০১২ এশিয়া কাপ বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় এক টুর্নামেন্ট। তামিমের টানা ৪ ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করার পর বিখ্যাত চার আঙ্গুলের সেলিব্রেশন, শচীন টেন্ডুল্কারের শততম আন্তর্জাতিক শতকের দিনে বাংলাদেশের ভারতবধ এবং প্রথমবারের মত বাংলাদেশের এশিয়া কাপের ফাইনালে কোয়ালিফাই করা। ২০১২ এশিয়া কাপ পুরোপুরি রূপকথার গল্পের মত হতে পারত যদি, ফাইনালে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের পরে ২য় বারের মত ৫০-ওভারের ক্রিকেট ম্যাচে পরাজিত করতে পারত। কিন্তু সেই স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। আর সেদিন বাংলাদেশ তার ক্রিকেট ইতিহাসের সবথেকে বেদনাময় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়।
টস জিতে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। আর তার আস্থার প্রতিদান দিয়ে বাংলাদেশের বোলাররা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের ২৩৬ রানে বেঁধে ফেলেন। বাংলাদেশের জন্য টার্গেট আরো ছোট হতে পারত, কিন্তু শেষ ওভারে শাহাদাত হোসেন-এর অনিয়ন্ত্রিত বোলিং-এর কারণে পাকিস্তান ১৯ রান তুলে নেয়। ম্যাচ শেষে সেই খরুচে শেষ ওভারটাই বাংলাদেশের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে সামনে আসে।
তামিম ইকবাল ব্যাট হাতে করে ফেলেন টুর্নামেন্টে নিজের টানা ৪র্থ অর্ধ শতক। কিন্তু আরেক ওপেনার নাজিমউদ্দিনের ৫২ বলে ১৬ এবং মিডল অর্ডারে নাসির হোসেনের ৬৩ বলে ২৮ রানের শম্বুক গতির ইনিংস বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটিকে কঠিন বানিয়ে দেয়। সাকিবের ৭২ বলের ৬৮ রানের কার্যকরী ইনিংসে বাংলাদেশ ম্যাচে ফিরে আসে। কিন্তু প্রথমবারের মত কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলার চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা একের পর একজন নিজেদের উইকেট বিলিয়ে আসতে থাকেন। ব্যাট হাতে শেষের দিকে মাশরাফির ৯ বলে ১৮ রানের ক্যামিও বাংলাদেশের আশা বাঁচিয়ে রাখে। ৪৮তম ওভারে সাইদ আজমলের বলে মাশরাফি আউট হয়ে গেলে ম্যাচ জেতানোর দায়িত্ব মাহমুদুল্লাহর কাঁধে বর্তায়।
শেষ ওভারের প্রথম বল। বাংলাদেশের হাতে আছে ২ উইকেট। ম্যাচ জেতার জন্য প্রয়োজন ৯ রান। বোলিং-এ এজাজ চিমা। স্ট্রাইকে মাহমুদুল্লাহ। প্রথম বলে ১ রান নিয়ে ফেলেন রিয়াদ। স্ট্রাইকে চলে যান আব্দুর রাজ্জাক। ২য় বলে রাজ্জাক লেগ বাই থেকে নেন আরেকটি সিঙ্গেল। ৩য় বলে মাহমুদুল্লাহ বল সীমানা পাড় করার জন্য জোরে ব্যাট চালান। কিন্তু চিমার স্লোয়ার বলকে ধরতে ব্যর্থ হোন তিনি। কোনো রান হল না। আর বাকি ছিল ৩ বল আর বাংলাদেশের প্রয়োজন আরো ৭ রান। পরের বলে পাকিস্তানের ফিল্ডারদের গাফিলতির সুযোগ নিয়ে দৌড়ে ৩ রান নিয়ে নেন মাহমুদুল্লাহ। ২ বলে লাগবে ৪ রান। কিন্তু স্ট্রাইক আবারো রাজ্জাকের কাছে। ৫ম বলে রাজ্জাক বাউন্ডারি হাকানোর জন্য ব্যাট চালালেন। কিন্তু বল ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে আঘাত হানল স্ট্যাম্পে। রাজ্জাক বোল্ড হয়ে গেলেন। শেষ বল খেলার জন্য মাঠে নামলেন শাহাদাত হোসেন। নিজের খরুচে শেষ ওভারের প্রায়শ্চিত করার সুযোগ ছিল শাহাদাত হোসেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন। শেষ বলে চিমার করা ইয়র্কার শাহাদাতের পায়ে লাগে এবং ব্যাটসম্যানরা ১টি লেগ বাই থেকে তুলে নেন। মাত্র ২ রানের ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ। ম্যাচশেষে সাকিব, মুশফিক, নাসিরদের কান্নার দৃশ্য এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবথেকে হৃদয়বিদারক দৃশ্য।