মানব ইতিহাসের এক লজ্জাজনক অধ্যায় হচ্ছে দাসত্ব প্রথা। পৃথিবীজুড়েই ভিন্ন ভিন্ন সমাজের বিত্তশালীরা অর্থের বিনিময়ে মানুষ ক্রয় করতে পারতেন।
এই ঘৃণ্য দাস প্রথার বিরুদ্ধে যুগে যুগে অসংখ্য বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। আর দাসত্বের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম সফল বিদ্রোহ ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সংঘটিত ‘হাইতি বিদ্রোহ’।
স্প্যানিশ অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলোম্বাস ১৪৯১ সালে হাইতির ভূখণ্ডটি আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই প্রথমে স্পেন ও পরে ফ্রান্স দেশটিতে উপনিবেশ গড়ে তোলে। ঔপনিবেশিক শক্তিরা হাইতির সোনা-সহ মহা মূল্যবান খনিজ সম্পদ ইউরোপে পাচার করতে থাকে। পক্ষান্তরে ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা অজানা রোগ ও মহামারিতে হাইতির অজস্র আদিবাসী মানুষের মৃত্যু ঘটে। দখলদারদের বর্বরতায় এক পর্যায় হাইতি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৬৭০ সালে ফরাসিদের দখলে যাওয়ার পর হাইতিতে আবার জনবসতি গড়ে উঠে। ১৭ ও ১৮ শতকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে প্রায় আট লাখ মানুষকে হাইতিতে দাস হিসেবে নিয়ে আসা হয়। ফরাসি মালিকদের খামারে এসব দাসদেরকে প্রতিনিয়ত অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত। তাদের সাথে খামারের গবাদী পশুর মত আচরণ করে হত। হাইতির এই দাস জনগোষ্ঠী একাধিকবার মালিকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু প্রতিবারই ফরাসিরা প্রবল শক্তি প্রয়োগ করে তাদের বিদ্রোহকে নৃশংসভাবে দমন করে।
১৭৮৯ সালে সূচনা হয় ফরাসি বিপ্লবের। এই বিপ্লব হাইতির বিপ্লবকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। সেই সময় হাইতির অধিবাসীরা ৫ শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। প্রথমে ছিল ধনী শ্বেতাঙ্গ ফরাসি ব্যবসায়ীরা। তাদের হাতেই ছিল হাইতির খামার, কারখানার মালিকানা। তারা প্রত্যেকেই বিপুল সংখ্যক দাসের মালিক ছিল। শ্বেতাঙ্গ ফরাসিদের মধ্যে কিছু ছিলেন যারা ছিলেন দোকানি, শিক্ষক, দক্ষ মিস্ত্রি। এই কম ক্ষমতাধর শ্বেতাঙ্গরা ছিলেন হাইতির ২য় শ্রেণী। তারা অল্প সংখ্যক দাসের মালিক ছিল। আরেক শ্রেনী হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসায়ী। তারাও ফরাসি ব্যবসায়ীদের মতই দাস ক্রয় করত।
বাকি দুই শ্রেণীর মধ্যে একটি হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা। হাইতির অধিবাসীদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ দাসের সংখ্যাই ছিল সর্বোচ্চ। এসব দাসের মধ্যে একদল ছিল যারা নিজেদের মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে হাইতির পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়ে তোলে ছিল। তারা ছিল বিদ্রোহী দাসদের নিয়ে গঠিত হাইতির ৫ম শ্রেণী। এসব বিদ্রোহী দাসদের বলা হত ‘মারুন’।
১৭৮৯ সালে হাইতির দাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লক্ষ এবং শ্বেতাঙ্গ ফরাসির সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের কাছাকাছি। মোট জনসংখ্যায় ১০ঃ১ অনুপাতে এগিয়ে থাকার কারণে হাইতির দাসরা কখনোই সম্পূর্ণভাবে ফরাসি শাসকদের বশীভূত হয়নি। দাসেরা সুযোগ পেলেই তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই তারা চূড়ান্তভাবে সফল হতে পারেনি।
১৭৯১ সালের আগস্ট মাসে বিদ্রোহী দাস টুসান লু’ভ্যার্তির নেতৃত্বে হাইতির দাসেরা চূড়ান্ত বিপ্লবের সূচনা করে। ১৭৯২ সালেই হাইতির মোট ভূমির এক-তৃতীয়াংশ তাদের অধিভুক্ত হয়ে পরে। ১৭৯১-১৮০১ সালের মধ্যে এই বিপ্লবে প্রায় ১ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ দাস এবং ২৪ হাজার শ্বেতাঙ্গ ফরাসি নিহত হয়। ১৭৯৩ সালে ফরাসিদের পাশাপাশি ব্রিটিশরাও হাইতিকে নিজেদের উপনিবেশ বানানোর জন্য আক্রমণ করে, কিন্তু দাসদের কাছে তারা পরাজিত হয়। এভাবেই ১৮০১ সালের মধ্যে বিপ্লবীরা হাইতিকে ফরাসিদের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে। একইবছর তারা পার্শ্ববর্তী দ্বীপ রাষ্ট্র ডমিনিক রিপাবলিককেও তাদের স্প্যানিশ উপনিবেশিকের হাত থেকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে।
১৮০৩ সালে ফ্রান্স-এর তৎকালীন শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট হাইতিকে আবারো ফ্রান্সের অধীনে আনার জন্য একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। তাঁর পাঠানো সৈন্যদলের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয় বিপ্লবীরা। দাসদের নেতা টুসানকে বন্দী করে ফ্রান্সে আনা হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও বিপ্লব থেমে থাকেনি। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র সাম্য- মৈত্রী – স্বাধীনতার বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে টুসানের বাহিনীর জেনারেল জ্যা জ্যাক ডেসালিনির নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আবারো সংঘটিত হয়। ১৮০৩ সালের ১৮ই নভেম্বর ডেসালিনের বাহিনী ফরাসিদেরকে পরাজিত করে। তারপর ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারি ডেসালিন হাইতির স্বাধীনতার ঘোষনা দেন।
এভাবেই হাইতি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দাস প্রথার বিরুদ্ধে হাইতির এই বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।