ঋতুপর্ণ ঘোষ। বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন এক ধারার প্রবক্তা, বাঙালির মনস্তত্বকে সফলভাবে তুলে ধরতে পারা এক পরিচালক, মধ্যবিত্ত সমাজকে তার স্ববিরোধী চিত্তের সাথে পরিচয় করে দেয়া এক চলচ্চিত্রকার। ক্ষণজন্মা এই পরিচালক তাঁর কর্মজীবনের ১৯ বছরে নির্মাণ করেছেন ১৯টি চলচ্চিত্র। যার মধ্যে ১২টি চলচ্চিত্রই লাভ করেছিল ভারতের জাতীয় পুরস্কার। আরো অনেক লম্বা হতে পারত তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকা। কিন্তু তা আর হল না। নিজের জন্মের অর্ধশতক পূর্ণ করার আগেই তিনি পাড়ি দেন মৃত্যুপুরিতে। তিনি না রইলেও রয়ে গেছে তাঁর চলচ্চিত্র। তাঁর কাজের মাধ্যমেই তিনি স্থান করে নিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ প্রতীম পরিচালক সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকদের মধ্যে।
১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর পিতা মাতা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা এবং মা ছিলেন চিত্রকর। সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন। কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে শুটিং-এ যেতেন তিনি। বাবার হাত ধরেই ক্যামেরা চালানো, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য লেখার হাতেখড়ি হয় ঋতুপর্ণ-র। চলচ্চিত্র তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হলেও কর্মজীবন শুরু করেন বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। কলকাতায় একজন “অ্যাডভারটাইসমেন্ট কপিরাইটার” হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ১৯৮০-র দশকে তাঁর বেশ কিছু বিজ্ঞাপন জনপ্রিয়তা লাভ করে। হিন্দি, ইংরেজি সংলাপের বঙ্গানুবাদ করে বিজ্ঞাপন প্রচার করার রীতি থেকে বেরিয়ে এসে বাংলায় বিজ্ঞাপনের শ্লোগান বানানোর ধারা শুরু করেন ঋতুপর্ণ। তাঁর নির্মিত বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে শারদ সম্মান ও বোরোলিনের বিজ্ঞাপন দুটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করার সময়ই বোধ হয় ঋতুপর্ণ বাঙালি মধ্যবিত্তদের মন জয় করার পন্থা জেনে গিয়েছিলেন।
১৯৯২ সাল থেকে ঋতুপর্ণ বাংলা চলচ্চিত্রে পা রাখেন। ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। পাশাপাশি কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের এসকল চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে দেয়া হল।
১৯৯২ সালে তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ মুক্তি পায়। ছবিটি তৈরি হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন মুনমুন সেন ও বসন্ত চৌধুরী।
১৯৯৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’ মুক্তি পায়। এক মা ও মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের এই ছবি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ছবিটি ১৯৯৫ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় ‘দহন’। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবির দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রানী হালদার একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অসুখ’ ছবিতে এক অভিনেত্রী ও তাঁর আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। এটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০০ সালে মুক্তি পায় ‘বাড়িওয়ালি’। এই ছবিতে এক নিঃসঙ্গ বিধবা নিজের বাড়িটি এক ফিল্ম প্রোডাকশনকে ভাড়া দেন। এই ছবির জন্য কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান। বার্লিন ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি পুরস্কৃত হয়।
২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘উৎসব’ ছবিটির জন্য পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই ছবির বিষয়বস্তু এক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন।
২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘তিতলি’ ছবিটি এক কিশোরীর বেড়ে ওঠা, কিশোরকালীন সংবেদনশীলতা এবং মা-মেয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে নির্মিত। ছবিটিতে অপর্ণা সেন ও তাঁর কন্যা কঙ্কনা সেন শর্মা একসাথে অভিনয় করেন।
২০০৩ সালে আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড’ অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন থ্রিলার ঘরানার ছবি ‘শুভ মহরৎ’। ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৩ সালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন ‘চোখের বালি’। ঐশ্বরিয়া রায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও রাইমা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রটি একইসাথে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়। শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার লাভের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করে এই চলচ্চিত্র।
২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি ছবি ‘রেইনকোট‘ মুক্তি পায়। এই ছবিটি মার্কিন সাহিত্যিক ও. হেনরি-এর ছোট গল্প “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” (১৯০৬) অবলম্বনে নির্মিত। ছবিটিতে ঐশ্বরিয়া রায় এবং অজয় দেবগন অভিনয় করেন। মাত্র ১৭ দিনে পুরো ছবিটির শুটিং শেষ হয় । ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৫ সালে তাঁর বাংলা ছবি ‘অন্তরমহল’ মুক্তি পায়। ব্রিটিশ আমলের এক জমিদারের পুত্র সন্তান লাভের ইচ্ছা, এই ইচ্ছার সামনে অসহায় এক স্ত্রী, স্বামীর কাছে হারানো প্রাধান্য ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া আরেক স্ত্রী এবং দেবী দুর্গার প্রতিমা বানানোর জন্য ডেকে আনা এক মৃৎশিল্পীকে নিয়ে কাহিনিটি তৈরি। ছবিটিতে অভিষেক বচ্চন, জ্যাকি শ্রফ, সোহা আলী খান, রুপা গাঙ্গুলি, রাইমা সেন অভিনয় করেন।
২০০৬ সালে মুক্তি পায় ‘দোসর’। সাদা-কালো এই চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং কঙ্কনা সেন শর্মা। প্রসেনজিৎ এই চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বিশেষ জুরি পুরস্কার লাভ করেন। কঙ্কনা সেন নিউইয়র্ক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৭ সালে ‘The Last Lear’ মুক্তি পায়। ইংরেজি ভাষায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রে একজন প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প দেখানো হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন। তাঁর সাথে পর্দা ভাগাভাগি করতে দেখা যায় প্রীতি জিনতা ও অর্জুন রামপালকে।
২০০৮ সালে মুক্তি পায় মানব সম্পর্কের গল্প নিয়ে তৈরি ছবি ‘খেলা’ । এটি মনীষা কৈরালার প্রথম বাংলা ছবি। একই বছর মুক্তি পায় ঋতুপর্ণ-র আরেক ছবি ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৯ সালে ‘আবহমান’ মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পান ঋতুপর্ণ।
চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে প্রথমে বাংলা চলচ্চিত্রে পা রাখলেও পরবর্তীতে অভিনেতা হিসেবেও আলাদা ছাপ ছেড়ে যান ঋতুপর্ণ। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র হচ্ছে ওড়িয়া ছবি ‘কথা দেইথিল্লি মা কু’। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। ২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ এবং সঞ্জয় নাগের ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ ছবিতে অভিনয় করেন।
ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত। এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়।
২০১৩ সালের ৩০ মে তাঁর কলকাতায় নিজ বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে ঋতুপর্ণের বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্র অবলম্বনে ‘সত্যান্বেষী’ ছবির শুটিং শেষ করেছিলেন। কিন্তু ছবিটি রিলিজ পাওয়ার এক মাস আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই মহান চলচ্চিত্রকার।
শিল্পীর কোনো লিঙ্গ হয় না বরং লিঙ্গকে একমাত্র মহান শিল্পীরাই অতিক্রম করে যেতে পারেন বলে মানতেন ঋতুপর্ণ। সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়মকে অতিক্রম করার মত প্রবল ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা তাঁর মাঝে উপস্থিত ছিলেন। তাই আমাদের এই হীনমন্য, দ্বিমুখী সমাজের সামনে সংস্কারবর্জিত, ব্যক্তিত্বের এক বিরাট স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ।
‘শিল্পীকে যে তার জেন্ডার অতিক্রম করে যেতে হয় সেটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। সামাজিক লিঙ্গ আমার পরিচয় নয়। শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না, এটা বাবা-মা, ই আমাকে শিখিয়েছিলেন।’
ঋতুপর্ণ ঘোষ
প্রত্যেক প্রজন্মের একজন মহিরূহ প্রয়োজন, যাঁর দিকে প্রচুর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকা যায়৷ যাঁর থেকে অনেক কিছু শেখা যায়, যাঁর ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যায় সংকটের সময় ৷ ঋতুপর্ণ ছিলেন সেই মহিরূহ৷ বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর স্মৃতি চিরকাল অমর থাকবে।