বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক সুপরিচিত নাম হচ্ছে অ্যালফ্রেড হিচকক। ‘মাস্টার অফ সাসপেন্স’ বলে খ্যাত এই ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালকের হাত ধরেই থ্রিলার চলচ্চিত্রের একটি জনরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানের থ্রিলার জনরা নিয়ে কাজ করা প্রতিটি পরিচালকই নিজের কাজে হিচককের সিনেমার প্রভাব এক বাক্যে মেনে নেয়। সিনেমার নতুন ভাষার সৃষ্টিকারী এই কিংবদন্তির জীবন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ।
এই মহান চলচ্চিত্র পরিচালকের জীবনের ১০টি অবাক করা ও অজানা তথ্য আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি।
১. পরিচালনার জন্য অস্কার না পাওয়াঃ
অ্যালফ্রেড হিচককের বর্ণিল কর্মজীবনের একটি বড় অপূর্ণতা হচ্ছে সেরা পরিচালকের অস্কার থেকে বঞ্চিত হওয়া। মোট পাঁচবার সেরা পরিচালকের অস্কারের জন্য মনোনিত হলেও একবারও পুরস্কারটি বগলদাবা করতে পারেননি হিচকক। তার পরিচালিত মোট ১৬টি সিনেমা অস্কারে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়, যার মধ্যে ১৯৪১ সালের ‘রেবেকা’ ছবিটি সেরা চলচ্চিত্রের অস্কার লাভ করে। কিন্তু সেবারও সেরা পরিচালকের অস্কার হিচককের অধরাই থেকে যায়। হিচকক, অরসন ওয়েলস, চার্লি চ্যাপলিন, স্ট্যানলি কুবরিকদের মত বিখ্যাত পরিচালকদের কাতারে চলে যান, যারা কখনো অস্কার পুরষ্কার পাননি। তবে চলচ্চিত্র পরিচালনায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬৮ সালে তিনি অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে জি. থ্যালবার্গ মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পান।
২. ৬ বছর বয়সে কারাবন্দীঃ
ছোটবেলায় বাবার কঠোর শাসনে থাকতে হত হিচকককে। একদিন হিচককের কোনো কাজে তার বাবা অসন্তুষ্ট হোন। হিচকককে শাস্তি দেয়ার জন্য তার বাবা তার হাতে একটি নোট দিয়ে পুলিশ স্টেশনের অফিসারের কাছে দিয়ে আসতে বলেন। সেই নোটে তার বাবা পুলিশ অফিসারকে কিছুক্ষণের জন্য তার ছেলেকে হাজতে বন্দী করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। নোটটি পড়ার পর পুলিশ অফিসার হিচকককে হাজতের ভিতরে নিয়ে যায় এবং বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৫ মিনিটের মত হিচকককে হাজতে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। মাত্র ৬ বছর বয়সী হিচকক এই ঘটনা দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। ছোটকালের এই ঘটনার পর থেকেই হিচকক পুলিশকে ভয় করা শুরু করেন। আর সেজন্যই বোধ হয় তার ছবিগুলোতে হিচকক পুলিশকে বেশিরভাগ সময়ে খলনায়ক রূপেই উপস্থাপন করতেন।
৩. নিজের তৈরি চলচ্চিত্র না দেখাঃ
সিনেমা হলে দর্শকদের ভয়ে ও আতঙ্কে তটস্থ রাখা হিচকক নিজেই নিজের সিনেমা দেখতে ভয় পেতেন। ১৯৬৩ সালে এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেন,
‘আমি আমার নিজের ছবি দেখতে ভয় পাই। কখনোই ছবিগুলো দেখতে চাই না। না-জানি মানুষ কীভাবে দেখে আমার ছবি!’
৪. ডিমভীতিঃ
পুলিশ ও নিজের সিনেমার পাশাপাশি হিচককের আরেকটি বস্তুকে প্রচন্ড ভয় পেতেন। আর সেই বস্তুটি হচ্ছে ডিম। ডিমের সাদা, গর্তহীন অবয়ব দেখলে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। ডিমের হলুদ কুসুম দেখলে তার গা ঘিনঘিন করে উঠত। তার কাছে কুসুমের হলুদ রঙ থেকে রক্তের লাল রঙ কম অস্বস্তিকর মনে হত। জীবনে কখনোই ডিম চেখে দেখেননি এমনটাই দাবি ছিল হিচককের।
৫. ব্রিটেনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রঃ
হিচকক পরিচালিত প্রথম ছবিগুলো ছিল নির্বাক চলচ্চিত্র। কিন্তু ১৯২৯ সালে হিচকক তার এবং ব্রিটেনের ইতিহাসের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘ব্ল্যাকমেল’ নির্মাণ করেন। এটি ছিল তার প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবি। শুটিং-এর সময় নির্বাক ছবি হিসেবেই তৈরি করা হলেও পরবর্তীতে সম্পাদনার সময় আমেরিকা থেকে আমদানি করা নতুন অডিও যন্ত্রপাতির সাহায্যে ছবিটিতে শব্দ যুক্ত করা হয়।
৬. কাহিনি গোপন রাখার জন্য ‘সাইকো’ বইটির সব কপি কিনে ফেলাঃ
‘সাইকো’ ছবিটিকে হলিউডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা থ্রিলার চলচ্চিত্র বলা হয়। আমেরিকান লেখক রবার্ট ব্লচের উপন্যাস ‘সাইকো’ অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘সাইকো’ ছবিটি। ছবির কাহিনি গোপন রাখার জন্য হিচকক ছবিটির কোনো পূর্ব প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেননি। ছবি শুরু এক মিনিট পরে এলেও তিনি কোনো দর্শককে, সে ব্রিটেনের রানীই হোক না কেন, সিনেমা হলে ঢুকতে দিবেন না বলে প্রচার করেন হিচকক। ছবির গল্পকে গোপন রাখার জন্য আরো বড় এক পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন হিচকক। আর তা হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার ডলার খরচ করে বাজারে উপন্যাসটির যত কপি আছে সবগুলো নিজেই কিনে ফেলা।
৭. ডিজনিল্যান্ডে শুটিং-এর অনুমতি না পাওয়াঃ
৬০-এর দশকে হিচকক ডিজনিল্যান্ডে তার একটি ছবির শুটিং করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনি তাকে শুটিং করার অনুমতি দেননি। অনুমতি না পাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল হিচককের ছবি ‘সাইকো’। আসলে ওয়াল্ট ডিজনির কাছে ‘সাইকো’ ছবিটি জঘন্য মনে হয়েছিল। তাই ‘সাইকো’ বানানোর অপরাধে হিচকককে ডিজনিল্যান্ডে শুটিং-এর অনুমতি তিনি দেননি।
৮. ক্যামিওঃ
বর্তমানের প্রতিটি মার্ভেল ছবিতেই আমরা অপেক্ষা করি কখন স্ট্যান লি-এর ক্যামিও দেখা যাবে। চলচ্চিত্রের মাঝখানে অল্প সময়ের জন্য কোনো বিখ্যাত অভিনেতা বা বিখ্যাত ব্যক্তির উপস্থিতিকে ক্যামিও বলা হয়ে থাকে। আর চলচ্চিত্রে ক্যামিওকে প্রথম জনপ্রিয় করে তোলেন হিচকক। নিজের প্রায় প্রতিটি ছবিতেই কিছু সময়ের জন্য তাকে দেখা যায় পর্দায়। হিচককের ছবি দেখার সময় দর্শকরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত হিচককের ক্যামিও-এর জন্য।
৯. অ্যালফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টসঃ
সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই পরিচালক বড় পর্দার পাশাপাশি টেলিভিশনেও একজন সফল পরিচালক ছিলেন। ১৯৫৫-১৯৬০ সাল পর্যন্ত সি.বি.সি নেটওয়ার্ক ও পরবর্তীতে ১৯৬০-১৯৬২ পর্যন্ত এন.বি.সি নেটওয়ার্কে প্রচারিত হয় অ্যালফ্রেড হিচকক পরিচালিত শো ‘অ্যালফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস’। ১৯৬২-এর জুন থেকে ‘অ্যালফ্রেড হিচকক আওয়ার’ নামে শো টি প্রচারিত হতে থাকে। ১৯৬৫ পর্যন্ত চলা এই সিরিজে মোট ৩৬১টি পর্ব প্রচারিত হয়। প্রতিটি এপিসোডে নতুন কাহিনী দেখানো হত। আর প্রতিটি এপিসোডের ওপেনিং শটে দেখা যেত হিচকককে। হিচকক নিজেই সেদিনের কাহিনীর সারসংক্ষেপ করতেন। তার টিভি শো-এর মাধ্যমে তিনি আমেরিকার প্রতি ঘরে এক পরিচিত নাম হয়ে যান।
১০. স্পিলবার্গের সাথে দেখা না করাঃ
স্টিভেন স্পিলবার্গ হিচককের চলচ্চিত্রের খুব বড় ভক্ত ছিলেন। স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘জস'(Jaws) সফলতা পেলে তিনি হিচককের সাথে দেখা করার চেষ্টা আরো বাড়িয়ে দেন। এমনকি হিচকক পরিচালিত শেষ ছবি ‘ফ্যামিলি প্লট’-এর সেটে পর্যন্ত চলে এসেছিলেন স্পিলবার্গ হিচককের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু হিচকক তার সাথে দেখা না করে দেহরক্ষীদের দিয়ে তাকে শুটিং সেট থেকে বের করে দেন। এই না দেখা করার পেছনের কারণ তিনি অভিনেতা ব্রুস ডার্ণকে জানান। আসলে ইউনিভার্সাল স্টুডিও-এর থিম পার্কে ‘জস’ রাইডের জন্য প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিকে তিনি ভয়েস ওভার করেছিলেন। তাই সেই ছবির পরিচালকের সাথে দেখা করতে তিনি লজ্জা বোধ করছিলেন।