প্রতি বিশ্বকাপেই আমরা যেমন দেখতে পাই অখ্যাত কোনো ফুটবলারকে বিশ্বকে চমকে দিতে, তেমনি দেখতে পাই বিশ্বসেরা ফুটবলারদের ফুটবলের শ্রেষ্ঠ আসরে ব্যর্থতায় পর্যদুস্ত হতে। রাশিয়া বিশ্বকাপও তার ব্যতিক্রম নয়। ফুটবল ঈশ্বরদের খেয়ালির স্বীকার হয়ে রাশিয়া বিশকাপেও অনেক তারকা ফুটবলার সন্তোষজনক পারফর্মেন্স তো দূরে থাক, জঘন্য প্রদর্শন করে হয়ে উঠেছেন নিজ সমর্থকদের চোখের চক্ষুশুল। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট মাতানোর আশায় এসে ব্যর্থতায় পর্যদুস্ত হয়ে ফিরে যাওয়া ৫ জনের কথা তুলে ধরব আজ।
১.ডেভিড ডি গিয়াঃ
অনেকের চোখেই ডি গিয়া হচ্ছেন বিশ্বের সেরা গোলকিপার। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দারুণ মৌসুম কাটানো ডি গিয়া এবারের বিশ্বকাপে স্পেনের গোলবারকে ভালোভাবেই সামলাবেন বলে মনে করা হচ্ছিল। অনেকে তো তাকে স্পেনের সন্ত ইকার ক্যাসিয়াসের সমকক্ষ বলেই মনে করছিল।
কিন্তু তার প্রতি স্পেন সমর্থকদের যে প্রত্যাশা ছিল তার সিকিভাগও পূরণ করতে পারেননি তিনি। ডি গিয়ার দুঃস্বপ্ন শুরু হয় বিশ্বকাপে পর্তুগালের বিপক্ষের প্রথম ম্যাচ থেকেই। সেই ম্যাচে রোনালদোর একটি শট তার হাত ফসকে ঢুকে যায় জালে। সেই ম্যাচে রোনালদো আরও ২টি গোল করে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম হ্যাট্রিক পূরণ করে। কিন্তু এরকম ভুল বা একটি খারাপ ম্যাচ সব বিখ্যাত গোলকিপারের ক্যারিয়ারেই আসে। তাই সবাই আশা করছিল যে ডি গিয়া আবারো তার আগের চেনারূপেই ফিরে আসবে।
কিন্তু তা আর হল কোথায়! পুরো বিশ্বকাপে একটিও বলার মত সেভ করতে ব্যর্থ হন ডি গিয়া। ২য় রাউন্ডে রাশিয়ার বিপক্ষে মূল ম্যাচে ১টি ও পেনাল্টি শুটআউটে ৪টির একটি পেনাল্টিও ঠেকাতে পারেননি ডি গিয়া। তারই ফলস্বরূপ টুর্নামেন্টের ২য় রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে যায় স্পেন। আর যার হাতে এবারের আসরের গোল্ডেন গ্লাভস উঠতে পারে বলে ধারণা করেছিলেন অনেকে, সেই ডি গিয়াই হয়ে গেলেন টুর্নামেন্টের অন্যতম বড় ব্যর্থতা।
২.নিকোলাস ওটামেন্ডিঃ
২০১৭-১৮ মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ জয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডিফেন্ডার ওটামেন্ডি। শিরোপা জেতার পাশাপাশি প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে সব থেকে বেশি পাস দেয়ার রেকর্ডও নিজের করে নেন ওটামেন্ডি। গোলকিপার সার্জিও রোমেরোর অনুপস্থিতিতে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ সামলাবেন ওটামেন্ডি এমন্টাই আশা করছিল আলবেসিলেস্তেদের সমর্থকেরা।
কিন্তু বিধি বাম। কোথায় তিনি সাভিও, রোহো, তাগ্লিয়াফিকোদেরকে সাথে আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ সামলাবেন, তিনি তো একের পর এক ফাউল করতেই যেন ব্যস্ত। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানোর থেকে প্রতিপক্ষকেই আক্রমণ করতে যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন ওটামেন্ডি।গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে দৃষ্টিকটুভাবে বলে কিক করে ক্রোয়েশিয়ার ইভান রাকিতিচকে আঘাত করেন ওটামেন্ডি। ২য় রাউন্ডের ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে পল পগবাকেও তিনি একইভাবে ফাউল করেন। দুইবারই রেফারি তাকে হলুদ কার্ড দিয়ে দন্ডিত করেন। প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে ঘায়েল করায় নিজের দক্ষতা দেখালেও নিজের আসল কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ ওটামেন্ডি। যার প্রমাণ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে আর্জেন্টিনার জালে জড়ানো ৯টি গোল।
৩.থমাস মুলারঃ
২০১০ ও ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে সবথেকে বেশি গোল করা থমাস মুলার রাশিয়া বিশ্বকাপেও জার্মানির হয়ে জ্বলে উঠবেন বলে আশা করছিল জার্মান সমর্থকেরা। আগের ২ বিশ্বকাপে মোট ১০টি গোল করা মুলারের সামনে সুযোগ ছিল বিশ্বকাপে নিজের ফর্মকে ধরে রেখে স্বদেশী মিরোস্লাভ ক্লোসার বিশ্বকাপে করা ১৬ গোলের রেকর্ডের কাছাকাছি চলে যাবার। কিন্তু জার্মানির প্রায় সব খেলোয়াড়ের মত মুলারও রাশিয়ায় নিজের ছায়া হয়েই ছিলেন।
রাশিয়া বিশ্বকাপে কোনো গোল অথবা এসিস্ট করতে ব্যর্থ হন মুলার। তার পারফর্মেন্স এতটাই হতাশাজনক ছিল যে গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচের জন্য তাকে প্রথম একাদশ থেকেই বের করে দেন কোচ লো। সেই ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে বদলি হিসেবে নেমেও ম্যাচে কোনো ছাপ রাখতে ব্যর্থ হন মুলার। গ্রুপ পর্বের ৩ ম্যাচের মধ্যে ২টিতে হেরে গিয়ে নিজ গ্রুপের ৪র্থ হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় আগের আসরের চ্যাম্পিয়নরা।
৪.রবার্ট লেভান্ডস্কিঃ
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচে ১৬ গোল করে রবার্ট লেভান্ডস্কি প্রায় একক নৈপুণ্যেই নিজের দল পোল্যান্ডকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে নিয়ে আসেন। বায়ার্ন মিউনিখের এই তারকা স্ট্রাইকারের এই দুরন্ত ফর্ম তার পুরো জাতিকে আশা দেখাচ্ছিল বিশ্বকাপে বড় কোনো সাফল্যের।
কিন্তু লেভান্ডস্কি রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হন। গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচে কোনো গোল করতে পারেননি লেভান্ডস্কি। নিজ দলের জন্য বলার মত কোনো গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেননি তিনি। লেভান্ডস্কির উপর অতিরিক্ত নির্ভর পোল্যান্ডও তাই নিজেদের গ্রুপে ৪র্থ হয়ে বিশ্বকাপের ১ম রাউন্ড থেকেই বাদ পরে যায়।
৫.গ্যাব্রিয়েল জেসুসঃ
গ্যাব্রিয়েল জেসুস ২০১৮ বিশ্বকাপ শুরু করেন ব্রাজিলের মূল স্ট্রাইকার হিসেবে। ভালো ফর্মে থাকা ফিরিমিনোকে শুরুর একাদশে না রেখে কোচ তিতে জেসুসের উপরই ভরসা রাখেন। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে সফল মৌসুম শেষ করা জেসুস তার প্রথম বিশ্বকাপে ভালো কিছু করবে এমন আশাতে বুক বেঁধেছিল অসংখ্য ব্রাজিল সমর্থক। অনেকে তো আবার জেসুসের মধ্যেই ‘দ্যা ফেনোমেনন’ রোনালদো লিমার ছায়া দেখতে পারছিলেন।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই প্রথম একাদশে তাকে নিয়ে দল সাজান কোচ টিটে। কিন্তু প্রতি ম্যাচেই এসের পর এক গোলের সুযোগ হাতছাড়া করতে থাকেন জেসুস। কৌতিনহো, নেইমার, পাউলিনহোদের গোলে ব্রাজিল পার পেতে থাকলেও দলের মূল স্ট্রাইকারের গোল না পাওয়া দলের জন্য মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়ায়। কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে আবারো জেসুসকে প্রথম একাদশে সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু জেসুস এই ম্যাচেও গোল করতে ব্যর্থ হন। একের পর এক সুযোগ দৃষ্টিকটুভাবে মিস করতে থাকেন জেসুস। শেষপর্যন্ত এসব সহজ সুযোগ হাতছাড়া করার খেসারত দিতে হয় ব্রাজিলকে। বেলজিয়ামের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পরে যায় সেলেকাওরা। গোলশুণ্য থেকেই জেসুসের প্রথম বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে।