বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তের মনে গত ২ সপ্তাহ ধরে একই কথা চলছে। “রাশিয়া বিশ্বকাপে এসব হচ্ছেটা কি?” একের পর এক চমক আর অঘটন ঘটে চলেছে এবারের টুর্নামেন্টে। আগে থেকে করে রাখা হিসাবগুলো কোনো কাজে আসছে না। ফুটবলের বিশেষজ্ঞরা এবারের বিশ্বকাপে যেন হয়ে যাচ্ছেন ‘বিশেষ অজ্ঞ’।
মূল টুর্নামেন্টে বল মাঠে গড়ানোর আগেই আসলে শুরু হয়ে যায় অঘটনের পালা। ইউরোপ থেকে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয় চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি, ও ব্রাজিল বিশ্বকাপের তৃতীয় হওয়া নেদারল্যান্ড। আর দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান কোপা আমেরিকা বিজেতা চিলিও ফুটবলের বিশ্বআসরে খেলার টিকিট থেকে হয় বঞ্চিত। দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনাও বিশ্বকাপে না খেলার তালিকায় যুক্ত হতে পারত। কিন্তু প্লে-অফে ভেনিজুয়েলার বিপক্ষে মেসির হ্যাট্রিকের উপর চড়ে বিশ্বকাপের টিকিট পায় আলবেসিলেস্তেরা।
রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে সম্ভাব্য বিজয়ীর তালিকায় যে নামগুলো দেখা যেত তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল ও স্পেন। কিন্তু মাঠের খেলায় সব হিসাব পাল্টে গিয়েছে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপজয়ী জার্মানি বাদ পড়ে যায় প্রথম রাউন্ড থেকেই। আর ২য় রাউন্ডের প্রথম দুই দিনেই বাদ পড়ে গিয়েছে আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল ও স্পেন।
সবথেকে বড় অঘটনের স্বীকার হয় জার্মানি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত দুই বিশ্বকাপ জয়ী দলগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রথম রাউন্ড থেকেই টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পরে যায় জার্মানি। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে ১-০ ব্যবধানে হার ছিল জার্মানির জন্য অশনি সংকেত। তারপরের ম্যাচে শেষ মিনিটের গোলে সুইডেনকে হারালেও পরের ম্যাচেই দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে জার্মানরা হেরে যায় ২-০ ব্যবধানে। জার্মানদের পঞ্চম শিরোপা জয়ের মিশন ১ম রাউন্ডেই সমাপ্ত হয়ে যায়।
মেসির কাঁধে চড়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছিল আর্জেন্টিনা সমর্থকরা। আর ২০১৬ ইউরোর মত আবারো রোনালদোর নেতৃত্বে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখছিল পর্তুগাল। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই দুই ফুটবলারের কেউই ২য় রাউন্ডের বৈতরণী পার করতে পারেননি। একইদিনে আর্জেন্টিনা ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে পরাজিত হয় আর পর্তুগাল উরুগুয়ের বিপক্ষে হেরে যায় ২-১ ব্যবধানে। আর এভাবেই খালি হাতেই রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে ফিরে যেতে হয় ফুটবলের এই দুই মহারথীকে।
স্পেন তাদের প্রথম ম্যাচে পর্তুগালের (পড়ুন রোনালদোর) সাথে ৩-৩ গোলে ড্র করে। পরের ম্যাচ দুটি জিতে স্পেন গ্রুপ চ্যাম্পিয়ান হিসেবেই ২য় রাউন্ডে কোয়ালিফাই করে। যদিও শেষ ম্যাচে মরক্কোর বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় ইনিয়েস্তাদের। ২য় রাউন্ডে তাদের প্রতিপক্ষ হয় স্বাগতিক রাশিয়া। ফুটবল ঐতিহ্যে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে থাকা স্পেন রাশিয়াকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখবে তা একপ্রকার অনুমিত ছিল সকলের কাছে। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপ আবারো সবার অনুমানকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দিল। ৯০ মিনিটের সমাপ্তি হল ১-১ ব্যবধানে। এক্সট্রা টাইমেও কোনো গোল না হলে ম্যাচ গড়ায় ভাগ্য লটারি পেনাল্টি শুটআউটে। সেখানে স্পেনের কোকে ও আসপাসের শট ঠেকিয়ে দিল রাশিয়ার গোলকিপার আকিনফিব। অন্যদিকে রাশিয়ার নেয়া একটিও পেনাল্টি ঠেকাতে পারেননি ডি গিয়া। এভাবেই স্বাগতিকদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে স্পেন বিদায় নেয় এবারের আসর থেকে।
পূর্বে বিশ্বকাপ জিতেছে এমন চারটি দল এখনো রাশিয়া বিশ্বকাপে টিকে আছে। তারা হল ব্রাজিল, ফ্রান্স, উরুগুয়ে এবং ইংল্যান্ড। এদের মধ্যে আবার কোয়ার্টার ফাইনালেই মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ফ্রান্স আর উরুগুয়ে। ব্রাজিল এবং ইংল্যান্ডের ২য় রাউন্ডের খেলা এখনো বাকি। রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রতিটা ধাপেই আমরা দেখছি একাধিক অঘটন। তাই ব্রাজিল ও ইংল্যান্ডের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে, তারা কি পরের রাউন্ডে উঠতে পারবে নাকি আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল ও স্পেনের ভাগ্য বরণ করবে তা নিয়ে চিন্তিত তাদের সমর্থকেরা।
রাশিয়া বিশ্বকাপ যেভাবে এগিয়ে চলছে, তাতে সেমিফাইনালে কখনো বিশ্বকাপ জেতেনি এমন একটি দল আমরা পাব তা একপ্রকার নিশ্চিত। তাই এবারের শিরোপা কি বেছে নেবে কোনো নতুন দেশকে তার যোগ্য হিসেবে নাকি শেষপর্যন্ত পরীক্ষিতদের মধ্যেই থেকে যাবে বিশ্বকাপের শিরোপা তা দেখার জন্য অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব।