বিশ্বকাপে ঘটা কিছু “অঘটনের” গল্প

এইবারের রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮ অাখ্যা পেয়েছে অঘটনের বিশ্বকাপ হিসেবে। অনেক নাম না জানা অখ্যাত দলই উঠে অাসছে, দেখাচ্ছে নিজেদের নৈপুণ্য। অন্যদিকে অনেক বড় বড় দলই ব্যর্থ হচ্ছে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে।

এ লেখাটি যখন পড়ছেন, ততক্ষণে জেনে গিয়েছেন গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি ইতোমধ্যে ছিটকে পড়েছে বিশ্বকাপ থেকে। এমনকি গতোবারের রানার্সঅাপ অার্জেন্টিনাও চলে গিয়েছিলো প্রায় খাদের কিনারায়।
এবারের এই লেখায় উঠে এসেছে বিগত বিশ্বকাপ গুলোয় বড় বড় দলগুলোর বাদ পড়বার এমনই কিছু ঘটনা, যা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অঘটন হিসেবেই অ্যাখা পেয়েছে বেশি।

১. ফ্রান্স – ২০০২

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স যখন ২০০২ সালের কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ খেলতে অাসলো, তখন তারা বিশ্বের অন্যতম সেরা স্কোয়াড হিসেবে অাখ্যা পেয়ে গেছে। হট ফেভারিট এই দলের স্ট্রাইকার তিনজনের মধ্যে থিয়েরি হেনরি ছিলেন সেই সিজনে ইংলিশ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ডেভিড ত্রেজগে ছিলেন ইতালীয়ান লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা আর সিসে ছিলেন ফ্রেঞ্চ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা।

কিন্তু দলনেতা জিদান তখনো ভুগছিলেন উরুর ইনজুরিতে। যার কারণে প্রথম দুই ম্যাচে মাঠে নামতে পারেননি। এদিকে এই সুযোগে উদ্বোধনী ম্যাচেই সেনেগাল ১-০ তে হারিয়ে দেয় ফ্রান্সকে, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বড় অঘটন হিসেবে চিহ্নিত। দ্বিতীয় খেলায় থিয়েরি অরির লালকার্ডের সুবাদে উরুগুয়ের সাথে গোলশুন্য ড্র হজম করে লেস ব্লুজরা।

তৃতীয় ম্যাচে ইনজুরি নিয়ে জিদান মাঠে নামলেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। ২-০ ব্যবধানে ডেনমার্কের কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় জিদানের ফ্রান্স।

২. ব্রাজিল – ১৯৬৬

অাটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ব্রাজিল দল চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা নিয়েই ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখে। এর অাগের দুটি অাসর, অর্থাৎ ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালেই শিরোপার স্বাদ পেয়েছিলো তারা। তাই ব্যাক টু ব্যাক চ্যাম্পিয়ন দলটিকে সবাই সমীহের চোখে দেখছিলো। পেলে, গ্যারিন্চা, জর্জিনহোর মতো তারকাসমৃদ্ধ এই দলটি যে তৃতীয় শিরোপার এক মুখ্য দাবীদার সেটি মেনে নিতে কেউ দ্বিধাবোধ করেননি।

সেবারের বিশ্বকাপ মিশনটা বেশ ভালোভাবেই শুরু করে সেলেকাওরা। শক্তিশালী বুলগেরিয়ার সাথে ২-০গোলে জয়। তবে এই ম্যাচে ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, যাকে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের জন্য দায়ী বলে মনে করেন অনেকেই।

ম্যাচের প্রথম গোল করার পর বুলগেরীয় ডিফেন্ডার জেচেভের এক কড়া ট্যকেলের শিকার হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় ব্রাজিলিয়ান প্লে-মেকার পেলেকে। গুরুতর অাঘাতের কারণে পরবর্তী এক ম্যাচের জন্য অানফিট ঘোষিত হন তিনি।
দ্বিতীয় ম্যাচে পেলেবিহীন ব্রাজিল পর্যুদস্ত হয় হাঙ্গেরীর কাছে। গডিসন পার্কে প্রায় ৫০ হাজার দর্শকের সামনে ৩-১ গোলের লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে সেলেকাওরা।

তৃতীয় ম্যাচে অানফিট থাকা সত্ত্বেও মাঠে নামানো হয় পেলে। বাচা-মারার লড়াইটা এবার ইউসেবিওর পর্তুগালের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকায় অাবারো ৩-১ গোলে পরাজয় বরণ করে প্রথম পর্ব থেকে ছিটকে পড়ার প্রথম নজির স্থাপন করে পূর্ববর্তী অাসরের শিরোপাধারী ব্রাজিল।

৩. স্পেন – ২০১৪

ব্রাজিলে যখন ২০১৪ বিশ্বকাপের অাসর বসলো, তখন পুরো ফুটবল বিশ্বই বুদ হয়ে অাছে স্পেনের টিকিটাকা ফুটবলের উন্মাদনায়। স্পেনের ঝুলিতে তখন বিশ্বকাপ ছাড়াও অারো দুটি শিরোপা শোভা পাচ্ছে। ২০০৮ এবং ২০১২ সালে ইউরো শিরোপা। তাদের সামনে সুযোগ অারো একটি বিশ্বকাপ জিতে পরপর দুইটি ইউরো ও বিশ্বকাপ জিতে নেবার।

গ্রুপে স্পেনের অন্যান্য প্রতিপক্ষ ছিলো এর অাগেরবারের ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ড, চিলি এবং অস্ট্রেলিয়া। বোদ্ধারা ভেবেছিলেন, স্পেন খুব সহজেই প্রথম রাউন্ড অতিক্রম করবে। কিন্তু নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের পরই সব হিসেব-নিকাশ পাল্টে যায়।

৫-১ গোলে ডাচদের অলঅাউট অ্যাটাকের কাছে বিধস্ত হয় ইউরোপের এই পরাশক্তি। পুরো ম্যাচে স্পেন কেবল ৩৪ শতাংশ সময়ই বল দখলে রাখতে পেরেছিলো। এর পরের ম্যাচেই চিলির বিপক্ষে ২-০ গোলে হার স্পেনের বিদায় নিশ্চিত করে। ভিসেন্তে দেল বস্কের অনুসারীরা তৃতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৩ গোলে উড়িয়ে দিলেও তা কেবল সান্তনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. কলম্বিয়া – ১৯৯৪

সাধারণত পেলের মতো কিংবদন্তি যখন কোনো দলের ব্যাপারে ভবিষ্যৎবানী করেন, তা কোনোভাবেই ফেলে দেবার মতো নয়। তাই তিনি যখন বললেন, ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ জিতবে কলম্বিয়া, তখন অনেকেই নড়েচড়ে বসলেন।

পেলের একথার পেছনে যুক্তিও ছিলো। বাছাই পর্বে অাগের বারের রানার্সঅাপ অার্জেন্টিনাকে ৫-০ ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখে ল্যাটিন এই দলটি, যা তাদের অপরিমেয় শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছিলো।

কিন্তু কলম্বিয়ার বিশ্বকাপ মিশনটা মোটেও মনমতো হয়নি। মাফিয়াদের অানাগোনা, জুয়া এবং স্পট ফিক্সিং এর দায়ে জর্জরিত হয়ে বিদায় নিতে হয় তাদের।
প্রথম ম্যাচেই রোমানিয়ার সাথে ৩-১ এর বিশাল ব্যবধানে পরাজয়ে কলম্বিয়ার সমর্থকদের স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করে। এর পরেই অাসে সেই কলঙ্কজনক মূহুর্ত। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দ্বিতীয় খেলায় ২-১ ব্যবধানে হেরে বিদায় নিশ্চিত হয় তাদের। তবে এই ম্যাচটি যতো না অালোচিত, তারথেকে বেশি অালোচিত হলো অান্দ্রেস এসকোবারের সেই অাত্মঘাতী গোল, যা ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়। সেইসাথে তার জীবনের পরিসমাপ্তিও।

৫. অার্জেন্টিনা – ২০০২

যখন এফ গ্রুপে ইংল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও সুইডেনের সাথে অার্জেন্টিনার নাম ঘোষনা করা হয়, তখন সকল ফুটবল বোদ্ধাই একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন, এটিই এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ অব ডেথ হতে চলেছে। এই সেই ডেথ যে অালভিসেলেস্তেদেরই ঘটবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি।

সেসময়কার অার্জেন্টাইন স্কোয়াডে তারকার যেন কোনো কমতি ছিলো না। মার্সেলো বিয়েলসার অধিনায়কত্বে রবার্তো অায়ালা, ক্লডিও লোপেজ, জ্যাভিয়ের জেনেত্তি, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, এরিয়েল ওর্তেগা, জুয়ান ভেরন, দিয়েগো সিমিওনি, পাবলো এইমার, কিলি গনজালেজ, হার্নান ক্রেসপোর দের নিয়ে গড়া দলটি ছিলো প্রশংসার দাবীদার। এমনকি এই দলে ছিলেন ক্লডিও ক্যানিজিয়ার মতো বিশ্বকাপ জয়ী বর্ষীয়ান তারকা ফুটবলার।

অার্জেন্টিনা সেবারের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ১-০ ব্যবধানে কষ্টার্জিত জয়ের মাধ্যমে।গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, যিনি কিনা সেই বিশ্বকাপের পরই অবসরে যাবেন, ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন। অন্যদিকে একই দিনের খেলায় ইংল্যান্ড সুইডেন এর সাথে ড্র করায়, ধারণা করা হচ্ছিলো গ্রুপে অার্জেন্টিনাই চালকের অাসনে বসতে চলেছে।

কিন্তু দুই নম্বর খেলায় ঘটে এক অঘটন। ইংরেজ ফরোয়ার্ড ডেভিভ বেকহ্যামের স্পট কিক থেকে এক দূর্দান্ত গোলে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হয় অার্জেন্টিনা।। যদিও সর্মথকদের তেমন একটা দুশ্চিন্তা ছিলো না। কেননা শেষ খেলায় সুইডেন এর সাথে জয় লাভ করলেই দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট নিশ্চিত করবে অার্জেন্টিনা।

পুরো ম্যাচ জুড়েই অাধিপত্য বিস্তার করা সত্ত্বেও সুইডিশদের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় অালভিসেলেস্তেদের (এই ম্যাচেই ত্রিশোর্ধ হেনরিক লারসনকে প্রতিস্থাপন করে অভিষেক ঘটে এক বিশ বছর বয়স্ক নতুন তারকার, যার নাম জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ)। কিন্তু পয়েন্ট টেবিল মোটেও সন্তোষজনক ছিলো না। এক জয় এবং এক ড্র -তে গ্রুপে তৃতীয় অবস্থানে নেমে যায় তারা। ফলাফল, প্রথম রাউন্ড থেকেই লজ্জাজনক বিদায়!

পুরো তিনটি খেলায়ই অার্জেন্টিনা অাক্রমন ছিলো দেখার মতো। প্রতিপক্ষের গোলবার অভিমুখে পঁয়তাল্লিশ টিরও বেশি শট নিয়েছিলো অাকাশি-নীল জার্সিধারীরা। এছাড়া তিনটি ম্যাচেই দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সময় ধরে বল দখলে রেখেছিলো তারা। যদিও এমন নৈপুন্য সমর্থকদের বাহবা ছাড়া অার কোনোকিছুই অর্জন করতে পারেনি। এর এক সপ্তাহ বাদেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নিয়ে অার্জেন্টিনার সমর্থকদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা ছিটিয়ে দেয়।

Post Author: Usamah Ibn Mizan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *