বিশ্বকাপের আসরে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারা প্রত্যেক ফুটবলারের স্বপ্ন। কিন্তু এই বিশ্বকাপের মঞ্চে জায়গা করে নেয়া এত সহজ নয়। প্রত্যেক ফুটবলারকেই বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে পৌছাতে হয় বিশ্বকাপের আসরে। বিশ্বকাপে খেলা প্রত্যেক ফুটবলারেরই রয়েছে সংগ্রামের নিজস্ব কাহিনি। দারিদ্র্য, ইঞ্জুরি, আসক্তি আরো অনেককিছুকে জয় করে তারা এসেছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। কিন্তু ২০১৮ সালের আসন্ন বিশ্বকাপে এমন কয়েকজন ফুটবলার রয়েছে যারা বেড়ে উঠেছেন যুদ্ধের মধ্যে, অস্ত্রের হাতে হারিয়েছেন নিজেদের আপনজনদের। যুদ্ধের হিংস্রতাকে জয় করে তারা স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বকাপের ময়দানে।
১. জারদান শাকিরিঃ
সুইজারল্যান্ডের মেসি বলা হয় যাকে, জারদান শাকিরির জন্ম ১৯৯১ সালে যুগোশ্লোভিয়ায় এক কসোভো আলবেনিয়ান পরিবারে। সেসময় সেই দেশে চলছিল কসোভোর যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে শাকিরির চাচাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। শাকিরির পরিবারকে তাদের নিজ ঘর থেকে বিতাড়িত করে দেয়া হয়। ১৯৯২ সালে শাকিরির পুরো পরিবার সুইজারল্যান্ডে তাদের বসতি স্থাপন করে।
সুইজারল্যান্ডে শাকিরিদের বাড়ির কাছেই ছিল এসভি আগস্ট ক্লাবের মাঠ। সেখানেই শাকিরির ফুটবল প্রতিভা সবার সামনে আসে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এসভি আগস্ট ও এফসি ব্যাসেল-এর যুবদলগুলোতে খেলার পর, ২০০৯ সালে বাসেল-এর মূল একাদশে তিনি জায়গা পান। একই বছর জাতীয় দলের হয়েও অভিষেক ঘটে তার। বায়ার্ন মিউনিখ ও ইন্টার মিলান-এর হয়ে খেলা এই উইঙ্গার বর্তমানে ইংল্যান্ডের ক্লাব স্টোক সিটির হয়ে খেলছেন। ২০১০ ও ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে খেলার পর এই বছর রাশিয়ায় নিজের তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন শাকিরি। সুইজারল্যান্ডের হয়ে খেললেও নিজের শিকড়কে কখনো ভুলে যাননি শাকিরি। তাই এখনো তার বুটে সুইজারল্যান্ড, কসোভো ও আলবেনিয়ার পতাকা একত্রে দেখা যায়।
২. ভিক্টর মোজেজঃ
নাইজেরিয়ার এই তারকা ফুটবলারকে মাত্র ১১ বছর বয়সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে হারাতে হয় নিজের বাবা-মাকে। তারপর তার নিকটবতী আত্মীয়রা তাকে ২০০২ সালে শরণার্থী হিসেবে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়। নিজের জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতিকে ভুলে থাকার উপায় হিসেবে মোজেজ বেছে নেয় ফুটবলকে। তার ফুটবল প্রতিভা সবার আগে শনাক্ত করে ক্রিস্টাল প্যালেস ক্লাব। স্কুল ফুটবলে তার দুরন্ত পারফর্মেন্সের কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই মোজেজ ক্রিস্টাল প্যালেস ক্লাবের মূল একাদশে জায়গা করে নেন।
বর্তমানে লন্ডনের ক্লাব চেলসির হয়ে মাঠ কাঁপানো এই ফুটবলার ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব ১৬ দলের হয়ে খেলেছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের হয়ে না খেলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জন্মভূমি নাইজেরিয়ার হয়ে খেলার। এখন পর্যন্ত নাইজেরিয়ার হয়ে ৩০টি ম্যাচ খেলা মোজেজ নাইজেরিয়ার হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলার জন্য প্রস্তুত।
৩. লুকা মড্রিচঃ
লুকা মড্রিচের জন্ম ১৯৮৫ সালে ক্রোয়েশিয়ায় পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৯০ সালে শুরু হয় ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধে সার্বিয়ান সেনাদের হাতে মড্রিচের দাদা মারা যান। সেনারা মড্রিচদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে তারা সীমান্তের নিকটবর্তী শহর জাদারে পালিয়ে যান।
যুদ্ধের নয় বছর মড্রিচের পরিবার থেকেছে বিভিন্ন হোটেলে, যেখানে প্রায়ই শত্রুপক্ষের সৈন্যরা গ্রেনেড হামলা করার চেষ্টা করত। সেই সময় হোটেলের সামনের পার্কিং লট হয়ে যায় মড্রিচের ফুটবল মাঠ। মড্রিচ প্রথমে তার প্রিয় ক্লাব এনকে জাদার-এ খেলার চেষ্টা করলেও, তার দুর্বল দৈহিক গড়নের জন্য তাকে তারা দলে নেয় না। প্রথমে বিমর্ষ হয়ে পড়লেও হার মানেননি মড্রিচ। তার ট্রেনিং তিনি চালিয়ে যান ও শেষপর্যন্ত এনকে জাদার-এর প্রতিপক্ষ দল ডাইনামো জাগ্রেভ-এ জায়গা করে নেন।
তারপর মড্রিচ পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পার-এ। সেখানে চার বছর খেলার পর তাকে দলে টেনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়ালের পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ান্স লিগ জয়ের অন্যতম কুশলীব বলে মনে করা হয়।
ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা মড্রিচ ২০০৬ ও ২০১৪-এর পরে ২০১৮ সালে তৃতীয়বারের মত বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন।ক্রোয়েশিয়া দলের মূল স্তম্ভ মড্রিচের কাঁধে ভর করেই ক্রোয়েশিয়া সমর্থকরা বিশ্বকাপে দলের ভালো ফলের আশায় বুক বাঁধছেন।