পেস বোলারের হাত থেকে আগুনের গোলার মত ছুটে আসা বল কিংবা স্পিনারের হাতের ঘূর্ণির ভেলকি আর তাদেরকে মোকাবিলা করার জন্য ব্যাটসম্যানদের কলা কৌশল এসবই হচ্ছে আধুনিক ক্রিকেটের এক নিয়মিত প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আমাদের বর্তমানের চিরচেনা ক্রিকেট তার শুরুর দিনগুলোতে ছিল অনেকটাই ভিন্ন। ব্যাটগুলো দেখতে ছিল অনেকটাই হকি স্টিকের মত, স্ট্যাম্প থাকত ২টি যার অবস্থান ছিল ব্যাটসম্যানের পিছনে ও বোলাররা বল করত মাটি গড়িয়ে। কালের পরিক্রমায় ক্রিকেটে আসে অনেক পরিবর্তন। কিন্তু একটি নিয়ম পাল্টাতে লেগে যায় অনেকসময়। আর তা হচ্ছে বোলারদের বল করার পদ্ধতি। তখন নিয়ম ছিল যে বোলাররা শুধুমাত্র তাদের কোমরের নিচ থেকে বল করতে পারবে। কোমরের উপর থেকে বল করা ছিল নিষিদ্ধ। কোমরের নিচে থেকে করা বল সামলাতে ব্যাটসম্যানদের কোনো ধরনের সমস্যায় পরতে হত না। ব্যাটসম্যানরা তাদের মন মর্জিমত চালাত ব্যাট। ব্যাট আর বলের মধ্যে ছিল না কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাই ক্রিকেট খেলাকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল পরিবর্তনের। আর ক্রিকেটের সঞ্জীবনীরূপে আসা এই পরিবর্তন কোনো নীতিনির্ধারক বা কোনো বিখ্যাত ক্রিকেটারের মাধ্যমে আসেনি। বরং বাড়ির উঠানে এক ব্রিটিশ তরুণী নিজের অজান্তেই আবিষ্কার করে ফেলেন ক্রিকেটের জন্য যুগান্তকারী এক নতুন বোলিং পদ্ধতি।
ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথমদিকের কথা। ক্যান্টারবেরির এক বাড়ির উঠোনে ব্যাটিং অনুশীলন করছিলেন জন উইলস। আর তাকে বল করে সহায়তা করছিলেন তার বোন ক্রিস্টিনা উইলস। ভাইয়ের অনুশীলনের জন্য প্রায়ই ক্রিস্টিনা এভাবে বল করতেন। কিন্তু সেইদিন তার পড়নে ছিল একটি গাউন। আন্ডারআর্ম বোলিং করার সময় তার হাত বারবার আটকে যাচ্ছিল তার গাউনে। বারবার এরকম হতে থাকায় একসময় বিরক্ত হয়ে কোমরের উপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে ক্রিস্টিনা বল ছুঁড়ে মারলেন তার ভাইয়ের দিকে। আচমকা এরকম বল আসায় চমকে উঠলেন জন। খেলতে পারলেন না বলটি। জন আবার তার বোনকে একইভাবে বল করতে বললেন। তারপর জন অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন এই ধরনের বলগুলোকে খেলার জন্য। কিন্তু ক্রিস্টিনার করা বলগুলোতে তিনি ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন যে কোমরের উপর থেকে করা বলগুলোকে এত সহজে খেলা যাবে না। তার জন্য প্রয়োজন আলাদা টেকনিক। তখনই তার মাথায় আসল এই নতুন পদ্ধতিতে বল করার চিন্তা।
বেশ কিছুদিন অনুশীলন করার পরে ১৮০৭ সালে কয়েকটি ম্যাচে তিনি নতুন এই পদ্ধতিতে বল করা শুরু করেন। কিন্তু তার এই নতুন টেকনিককে কেউ মেনে নিতে পারল না। তাকে প্রবল প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হল। বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা প্রতিবাদ জানালেন, মাঠের আম্পায়াররা নো-বল ঘোষণা করলেন। অনেকসময় দর্শকরা পর্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে মাঠে ঢুকে খেলা পণ্ড করে দিলেন। কিন্তু তারপরও জন হাল ছাড়লেন না।
প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি রাউন্ড-আর্ম বোলিং করে গেলেন। তার নিরলস পরিশ্রমের ফলে ধীরে ধীরে তিনি কিছু লোকের সমর্থন আদায় করে ফেলেন।
তারপর ১৮২২ সালের জুলাই মাসে লর্ডসের মাঠে কেন্টের হয়ে জন এমসিসির বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান। সেই খেলায় রাউন্ড-আর্ম বোলিং করায় আম্পায়ার নো বলের ঘোষণা করলে জন চূড়ান্তভাবে অপমানিত বোধ করেন। তিনি তৎক্ষণাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে বের হয়ে যান মাঠ থেকে এবং নিজের ঘোড়ায় চড়ে চলে যান খেলা ছেড়ে। যাওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়ে যান যে আর কখনো ক্রিকেট খেলবেন না।
ততদিনে অবশ্য জনের দেখাদেখি আরো অনেকে রাউন্ড-আর্ম বোলিং করা শুরু করে দিয়েছিল। কোমরের উপর থেকে বল করে যে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায় তা অনেক বোলারের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তখন অনেকেই আবার রাউন্ড-আর্ম বোলিং করার ফাঁকে ফাঁকে আম্পায়ারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাঁধের উপরেও বল করা শুরু করেন। এভাবেই রাউন্ড-আর্ম বোলিং পরবর্তীতে আমাদের বর্তমানের পরিচিত ওভার-আর্ম বোলিং এর সূচণা করে।
শেষপর্যন্ত ১৮৬৪ সালে ওভার-আর্ম বোলিংকে ক্রিকেটে বৈধতা দেয়া হয়। ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা তাই ১৮৬৪ সালকেই আধুনিক ক্রিকেটের সূচণার বছর বলে মনে করেন।
আর এভাবেই এক অতি সাধারণ তরুণীর হাত ধরে ও তার ভাইয়ের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্রিকেট পেয়ে যায় তার বর্তমানের স্বীকৃত বোলিং পদ্ধতি। আর ক্রিকেট পদার্পণ করে তার আধুনিক যুগে।