বইঃ শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশকঃ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
প্রকাশকালঃ ১৯৯৭
বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত বিতর্কিত ব্যক্তির নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি একাধারে কালজয়ী এক সাহিত্যিক, বাংলা উপন্যাসের জনয়িতা ও একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক। কিন্তু তার অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে যে অংশটি সবথেকে আলোচিত হয় তা হচ্ছে তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। সাম্প্রদায়িকতার লেবেল তার উপর এমনভাবে সেটে গিয়েছে যে তার সাহিত্য রচনার শত বর্ষ পরেও তিনি বাংলার বৃহৎ মুসলিম সমাজের কাছে এখনো পরিত্যাজ্য। বঙ্কিম সাহিত্যের উপর মুসলিমদের বিদ্বেষকে লেখক আহমদ ছফা আরো ভালোভাবে বুঝতে চেয়েছেন। তিনি বঙ্কিম সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করে বুঝতে চেয়েছেন কেন একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি হয়েও বঙ্কিম স্তুতি গেয়েছেন পূর্বের এক কল্পিত সময়ের। তিনি জানতে চেয়েছেন কেনইবা সেই সময়ের অন্যান্য সাম্প্রদায়িক লেখকদের কথা না বলে, বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার সব দোষ একা বঙ্কিমের উপর চাপানো হয়।
ছফা বঙ্কিমকে তার সময়ের অন্যান্য লেখকদের থেকে একটি দিক থেকে আলাদা বলে মনে করতেন। আর তা হল তার রাষ্ট্র চিন্তায়। বঙ্কিম প্রথম লেখক যিনি স্বপ্ন দেখতেন এক হিন্দু রাষ্ট্রের। আর তার সেই স্বপ্নের বীজ অন্যদের মধ্যে বুনে দেয়ার জন্য তিনি ব্যবহার করেন তার লেখনীকে। ফকির-সন্ন্যাসীদের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব নিয়ে বঙ্কিমের উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’-তে বঙ্কিম সেই আন্দোলনকে শুধুমাত্র হিন্দু সন্ন্যাসীদের আন্দোলন রূপে চিত্রিত করেন, ফকিরদের কথা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেন। একইভাবে তার ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাস হিন্দুত্ববাদী বিপ্লবীদের আন্দোলনের রসদ যুগিয়েছে। তারপর ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত ‘কৃষ্ণচরিত’ উপন্যাসে বঙ্কিম শ্রী কৃষ্ণের ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে তাকে এক প্রতাপশালী হিন্দু রাজা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
ছফার নিজের জবানীতে,” ‘আনন্দমঠকে’ যদি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, ‘কৃষ্ণচরিতের’ সাথে তুলনা করতে হবে ডাস ক্যাপিটালের সঙ্গে। আনন্দমঠে বঙ্কিম যে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রণধ্বনিটি উচ্চারণ করেছেন এবং কৃষ্ণচরিতে সেই হিন্দুরাষ্ট্রের একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন।”
কিন্তু তার এই হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নই পরবর্তীতে ভারতকে প্রথমে দ্বিখণ্ডিত ও পরে ত্রিখণ্ডিত হওয়ার পথে ঠেলে দেয় বলে মনে করেন ছফা। তারপরও বঙ্কিমের উপর সাম্প্রদায়িকতার সম্পূর্ণ দায় না চাপিয়ে তাকে তার সময়ের সন্তান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তৈরি নিয়তির এক ক্রীড়নক বলেই মনে করেন ছফা।
যাদের বঙ্কিম ও ছফা উভয়ের সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ আছে তারা পড়ে দেখতে পারেন বইটি। আশা করছি আপনাদের মন্দ লাগবে না।