বইঃ অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯৬
একজন সাহিত্যিকের লেখনী তার আসল জীবন থেকে ঠিক কতটা ভিন্ন ? শুধুমাত্র কল্পনা থেকে সৃষ্ট সাহিত্য কখনোই কালজয়ী হতে পারে না যতক্ষণ না তাতে মেশানো হয় জীবনের সূক্ষ্ম অনুভুতি। আহমদ ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ যেন সেই সত্যকেই আবার প্রমাণিত করছে। ছফা নিজের জীবনের ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তাতে কল্পনার রঙ চড়িয়ে একাধিক কালজয়ী উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন (গাভী বিত্তান্ত, অলাতচক্র)। কিন্তু তার এই রচনাটি অন্যগুলো থেকে আলাদা। কেননা এখানে ছফা তার একান্ত ব্যক্তিজীবনকে ছদ্মনামের আড়ালে বর্ণনা করেছেন। বাস্তব জীবনের ছফা উপন্যাসে হয়ে গেলেন জাহিদ। উপন্যাসের শুরুতেই জাহিদ কথা বলতে থাকে তার প্রিয়তমা সোহিনীর সাথে। সোহিনীর কাছে নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করার আগে জাহিদ তার অতীতের প্রেমিকাদের কথা বলা শুরু করে। নিজের ভেতরে জমে থাকা সেই অতীত স্মৃতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজেকে সোহিনীর কাছে সঁপে দিতে পারে। প্রথমেই সে বলে চারুকলার ছাত্রী দুরদানার কথা। যার প্রচণ্ড ডানপিটে স্বভাব তাকে তার আশেপাশের অন্য সবার থেকে আলাদা করে তোলে। তার এই অনন্যতাই জাহিদকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। কিন্তু যখনই দুরদানা দূরের অস্পৃশ্য নক্ষত্র থেকে জাহিদের সামনে এক সাধারণ নারী হিসেবে আবির্ভূত হয় তখনই ভেঙ্গে যায় তার এই মোহ। তারপর কেটে যায় কিছু বছর। এবার জাহিদের জীবনে আসে এক নতুন নারী, শামারোখা।
উচ্চশিক্ষিতা, একরোখা এবং অসম্ভব সুন্দরী এই নারীর সাথে জাহিদের পরিচয় হয় কাকতালীয়ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে তার নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য জাহিদকে পোড়াতে হয় অনেক কাঠখোড়। কিন্তু শামারোখার সৌন্দর্যে জাহিদ এতটাই বিমুগ্ধ হয়েছিল যে কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করল না। জাহিদ জানত যে সে শামারোখার জীবনের একমাত্র পুরুষ নয়। আরও জানত যে শামারোখার আভিজাত্যের সাথে সে কোনোদিনও নিজেকে মেলাতে পারবে না। তারপরও শামারোখার আবেশ থেকে জাহিদ নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই সম্পর্কটিও টিকে না। সত্যি বলতে জাহিদ শামারোখাকে কখনোই ঠিক বুঝতে পারে না। আর তার এই না বুঝতে পারাটাই যেন স্বাভাবিক। আসলে ছফা শিরোনামেই এই উপন্যাসটির মূলকথা বলে দিয়েছেন। একজন নারী যখন কারো প্রেমিকা হয়ে উঠে তখন সে তার প্রেমিকের চোখে এক সাধারণ নারী থেকেও বেশি কিছু হয়ে ওঠে। তাকে বোঝা অসম্ভব, নিজের কাছে আগলে রাখার তো অকল্পনীয় । তার কাছে শুধু নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করা সম্ভব।
এই উপন্যাসটির শুধুমাত্র প্রথম খন্ড আহমদ ছফা লিখে যেতে পেরেছেন। ছফার জীবনে তারপরে আসা ঈশ্বরীরা তাই চিরকাল আমাদের অগোচরেই রয়ে যাবেন।