সময়টা ১৯৯৩। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করে আনা হয়েছে বাকের ভাইয়ের লাশ। কিছুক্ষণ আগেই হত্যাকান্ডের আসামী হিসেবে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছিল তাকে। নিজ এলাকার প্রাণপুরুষ ছিলেন বাকের ভাই, প্রয়োজনে পাশে দাড়িয়েছেন সকলের, কিন্তু ফাঁসির পরে তার মৃতদেহ বহন করতে আসেনি তাদের কেউই। এসেছিল শুধু মুনা। না, তথাকথিত কোনো সম্পর্ক তাদের মাঝে ছিল না। কিন্তু তারপরও বাকের ভাইয়ের নিথর, প্রাণহীন দেহের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কেঁদে যাচ্ছিল মুনা। সেখানে ছিল না আর কেউ।
উপরের দৃশ্যটি নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর উপন্যাস অবলম্বনে তারই পরিচালনায় নির্মিত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ থেকে নেয়া। নাটকের শেষ পর্বে টেলিভিশন পর্দায় কাঁদছিলেন মুনা রূপে সুবর্ণা মুস্তাফা আর তার সাথে সাথে কাঁদছিল দেশের হাজারো দর্শক। শুধুমাত্র নিজের অভিনয় দিয়ে মুনার বেদনায় তিনি পুরো দেশবাসীকে সমব্যাথী করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ আজও বাকের ভাই রূপে আসাদুজ্জামান নূর ও মুনা রূপে সুবর্ণা মুস্তাফাকে ভুলতে পারেনি। আজ বাংলাদেশের অভিনয়জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি সুবর্ণা মুস্তাফার জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরব।
জন্ম ও অভিনয়ে প্রবেশঃ
সুবর্ণা মুস্তাফা ১৯৫৯ সালের ২রা ডিসেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নে। তার বাবা গোলাম মুস্তাফা ছিলেন একজন সুবিখ্যাত অভিনেতা, যিনি ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ সিনেমায় অভিনয় করার জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। মা হোসনে আরা মুস্তাফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করে পরবর্তীতে পাকিস্তান রেডিওতে প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন। মায়ের সহায়তায় মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বেতার নাটকে কাজ করা শুরু করেন সুবর্ণা। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি প্রথম টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে নিয়মিত টেলিভিশনে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ সালে ‘বরফ গলা নদী’তে অভিনয় দিয়ে টেলিভিশনে আবার তার যাত্রা শুরু।
চলচ্চিত্রে প্রবেশঃ
১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে আসেন। গতানুগতিক চলচ্চিত্র থেকে অন্যরকম হওয়ায় দর্শক জনপ্রিয়তা পায়নি ছবিটি। কিন্তু এখনো ‘ঘুড্ডি’-কে বাংলা সিনেমার অন্যতম আধুনিক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করা হয়।
১৯৮৩ সালে ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তার পরের বছর মুক্তি পায় তার তৃতীয় চলচ্চিত্র বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’।
রূপালি পর্দায় যথেষ্ট সাফল্য পেলেও সুবর্ণা নিয়মিত হননি সিনেমায়। টেলিভিশনে ও থিয়েটারে প্রতাপের সাথে অভিনয় করে গেলেও চলচ্চিত্রে তাকে দেখা গিয়েছে কদাচিৎ। তা সত্ত্বেও ‘পালাবি কোথায়’, ‘কমান্ডার’, ‘অপহরণ’ ইত্যাদি জনপ্রিয় সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র তার বর্তমান স্বামী বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত ‘গহীন বালুচর’।
টেলিভিশন ও সুবর্ণা:
বাংলা টেলিভিশনের সর্বকালের সেরা ও জনপ্রিয় অভিনেত্রীর কাতারে সবসময় স্থান পাবেন সুবর্ণা মুস্তাফা। একসময় সুবর্ণা-আফজাল হোসেন-এর জুটি বাংলা নাটকের সবথেকে জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য জুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘পারলে না রুমকি’ নাটকটিতে এই জুটির রসায়ন আজও দর্শকদের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে।
‘কোথাও কেউ নেই’ যা সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবথেকে জনপ্রিয় নাটক, সেখানে অভিনয়ের পাশাপাশি তাকে ‘অয়োময়’, ‘বারো রকম মানুষ’, ‘আজ রবিবার’ ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকেও তিনি প্রধান চরিত্রে কাজ করেছেন।
ব্যক্তিজীবনঃ
১৯৮৬ সালে আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীকে বিয়ে করেন সুবর্ণা। দীর্ঘ ২২ বছরের বৈবাহিক জীবনের পরে ২০০৮ সালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর পরিচালক বদরুল আনাম সৌদের সাথে তার বিয়ে হয়। অসম বয়সের সৌদের সাথে বিয়ে করার কারণে অনেকেই সুবর্ণার সমালোচনায় মুখর হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সেই সমালোচনার ঢেউ এখন অনেকটাই স্তিমিত।
সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনয়ের পাশাপাশি ২০১৫ সাল থেকে রেডিওতে ক্রিকেট ধারাভাষ্যক হিসেবে কাজ করেছেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রী বর্তমানে সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
জনপ্রিয়তা ও দক্ষতা, উভয় ক্ষেত্রেই সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পেরেছেন এরকম অভিনেত্রীর সংখ্যা বাংলাদেশে হাতেগোনা। আর সেই ছোট্ট তালিকায় সবথেকে উজ্জ্বল নাম হিসেবে ‘সুবর্ণা মুস্তাফা’ সদাভাস্বর থাকবেন তা বলাই বাহুল্য।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://bn.wikipedia.org/wiki/ সুবর্ণা_মুস্তাফা
২.https://biographybd.com/suborna-mustafa/
৩. www.dhakatimes24.com/2018/12/02/104951/৫৯-বসন্তে-সুবর্ণা-মুস্তাফা
৪. http://www.dainikamadershomoy.com/post/182231
ফিচার ইমেজঃ http://thedailynewnation.com/news/77658/ghuddi-to-be-screened-today-at-shilpakala-academy.html