“ আহমদ ছফা চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক।”
—– মুহম্মদ জাফর ইকবাল
আহমদ ছফা, অনেকের চোখে যিনি মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক, ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশে জন্মগ্রহণ করেন। হেদায়েত আলী ও আসিয়া খাতুন দম্পত্তির দ্বিতীয় সন্তান ছফার শিক্ষাজীবন শুরু হয় পিতার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রবস্থাতেই কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন ছফা।বিপ্লবী কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে রেললাইন পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছিলেন তিনি। এজন্য অবশ্য তাকে বেশ কিছুদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে থাকতে হয়। ১৯৬২সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। কিন্তু মন বসে নি তাঁর সেখানে। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭০ সালে এম এ পরীক্ষা দেয়ার আগেই পেয়ে যান বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তি। আর এ গবেষণার সূত্র ধরেই তিনি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সংস্পর্শে আসেন। তারপর তাদের মাঝে গড়ে ওঠে গুরু-শিষ্যের এক অকৃত্রিম বন্ধন, যার ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে ছফা রচনা করেন ‘যদ্যপি আমার গুরু’।যদিও সে পিএইচডি তাঁর শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণই রয়ে যায়।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ছফা চলে যান ভারতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন ‘দাবানল’ পত্রিকা। ভারতে শরণার্থী হিসেবে কাটানো তাঁর সেই দিনগুলো থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৫ সালে তিনি রচনা করেন ‘অলাতচক্র’ উপন্যাস, যেখানে একইসাথে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাধারণ মানুষের ত্যাগ, ভারতে আশ্রিতদের করুণ অবস্থা, প্রবাসে বসে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাওয়ার সংগ্রামের চিত্র এবং কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির যুদ্ধের সময়েও নিজের ঘর গোছানোর নির্লজ্জ প্রচেষ্টার কথা ছফা তাঁর স্বভাবসুলভ অকপট ভঙ্গিতে বলে গিয়েছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসেবে বের হয় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। ১৯৭২ সালে ছফা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশ করা শুরু করেন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায়। এসব প্রবন্ধে তিনি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। তাদের সুবিধাবাদী মনোভাব, সুবিধা অনুসারে শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে কথা বলা এবং পরবর্তীতে আরও সুবিধার জন্য পূর্বের বক্তব্য থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া, পুরস্কারের জন্য তোষামোদ করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে ছফা কলমের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেন। তখন ছফার এই প্রবন্ধের জন্য দেশের বুদ্ধিজীবীরা একইসাথে আগ্রহ ও আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতেন। মানুষ যেমন দাবানলের দিকে যুগপৎ ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে থাকে তেমনি। এমনি ভয়ংকর সুন্দর ছিল তার লেখনী।
১৯৭৫ সালে বের হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ওঙ্কার। এত অল্প কলেবরে রচিত এমন স্বার্থক উপন্যাস পুরো বাংলা সাহিত্যেই বিরল।এই উপন্যাসের আইডিয়া নাকি তিনি পেয়েছিলেন রাগ করে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় হেঁটে যাওয়ার পথে।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন ছফা।
১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ছফার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। গ্রন্থে অর্ন্তভুক্ত বইয়ের নামেই রচিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ও সমভাবে সমালোচিত রচনা। যেসব মুসলমান বাংলায় কথা বলেন তাদের জাতিগত ও ভাষাগত হীনম্মন্যতাই এ প্রবন্ধের মূল উপজীব্য বিষয়।
আমাদের অনেকেরই ছফা পড়া শুরু হয়েছে ‘গাভী বিত্তান্ত’ দিয়ে। ছফার অন্যতম জনপ্রিয় এ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। এ রচনায় ছফা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি ও শিক্ষক-রাজনীতির অন্তঃসারশূণ্যতাকে তুলে ধরেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে অকৃতদার ছফা বেশ কয়েকজন নারীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। শামীম শিকদার ও সুরাইয়া খানম এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এদের সাথে প্রণয় সম্পর্কের ভিত্তিতেই ছফা রচনা করেন তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’।
আহমদ ছফা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুতোষ রচনাসহ সাহিত্যের সকলক্ষেত্রেই পদচিহ্ন রেখেছেন। তবে তাঁর প্রবন্ধগুলো বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কেননা সমাজকে তার নিজের কলুষতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর মত জটিল কাজ ছফা করেছেন তার প্রবন্ধের মাধ্যমে, যার অনেকগুলো বর্তমান সমাজ বাস্তবতায়ও পূর্বের মতই প্রাসঙ্গিক। ছফার প্রবন্ধগুলো তাঁর প্রবল মেধা ও নিখুঁত বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় বহন করে।
ছফা যেমন বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সমালোচনা করেছেন; তেমনি তার বিরুদ্ধেও সমালোচনা নেহাত কম নয়। এর মধ্যে তার সবচেয়ে বড় দোষ- তিনি নাকি মানুষের সমালোচনা সইতে পারতেন না।এছাড়া তার গুরু জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের প্রতি তার অন্ধ গুরুভক্তি ছিল অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু। তাছাড়া, অনেকের অভিযোগ শিল্পী এস এম সুলতানকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে নাকি ছফা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কাইয়ুম চৌধুরীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি স্বৈরাচারী সরকারের সমালোচনাতেও তিনি নাকি ছিলেন একচোখা।
আহমদ ছফা জীবিতাবস্থায় কোনো বড় পুরস্কার গ্রহণ করেননি। তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।তবে ১৯৮০ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। মৃত্যুর পরে ২০০২ সালে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয়।
২০০১ সালের ২৮শে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে ছফা মৃত্যুবরণ করেন। পরেরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ছফার সম্পর্কে নানা মানুষের নানা মত। অনেকে যেমন তাঁকে গুরু বলে স্বীকার করে; তেমনি অনেকে তাঁকে একচোখা ও ‘অ্যাটেনশন সিকার’ বলে অভিযুক্ত করে।
কিন্তু তাঁর যতই সমালোচনা করা হোক না কেন ছফার লেখাকে, ছফার প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করা যাবে না। তাই জীবিতাবস্থায় আহমদ ছফা পাঠক বা তাঁর চারপাশের বিশিষ্টজনদের কাছে যেমনই থাকুন, মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশের পাঠকসমাজ পরম আগ্রহে ও মমতায় আহমদ ছফার লেখা ও চিন্তাকে বুকে ধারণ করছে।
তথ্যসূত্রঃ
১.আহমদ ছফা, ইমদাদুল হক মিলন।
২.বলপয়েন্ট , হুমায়ুন আহমেদ ।
৩. আহমদ ছফা ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
৪. মানুষ আহমদ ছফা, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর।