১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মত বিশ্ব ক্রিকেটের সব থেকে বড় আসরে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড-এর মাটিতে সেবার স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম জয় নিশ্চিত করার পরে শক্তিশালী পাকিস্তানকে কুপোকাত করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলার ছেলেরা। তারপর কেটে গেছে দুই যুগ। লন্ডনের থেমস আর ঢাকার বুড়িগঙ্গায় বয়ে গেছে অগণিত স্রোত। বাংলাদেশ সেই সময়ের মাত্র হাটতে শেখা ক্রিকেট এখন নিজ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠছে। ২০ বছর আগে যে আসরে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে গিয়েছিল নবাগত এক ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে বিশ বছর পরে সেই একই উপলক্ষ্যে সেই একই দেশে বাংলাদেশ যাচ্ছে আসরের অন্যতম অভিজ্ঞ দল নিয়ে। একদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই দশকের এক চক্রের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে এই বিশ্বকাপে। এখন এই সমাপ্তি কি বাংলাদেশের জন্য হবে ‘মধুরেণ সমাপন’ নাকি হয়ে থাকবে এক রাশ হতাশার গল্প তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে এদেশের অগণিত ক্রিকেটভক্ত।
বর্তমান বাংলাদেশ দলের কথা বলতে প্রথমেই বলতে হবে পাঁচজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের কথা যাদেরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দলটি। তারা হলেন – অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, সহ-অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। এদের মাঝে মাশরাফি আর মুশফিক ইতিমধ্যেই খেলে ফেলেছেন ২০০টির ও বেশি এক দিবসীয় ম্যাচে। আর এই বিশ্বকাপেই নিজেদের ২০০তম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ফেলতে পারেন তামিম ও সাকিব।
বর্তমান বাংলাদেশ দলের চারজন- মাশরাফি, সাকিব, তামিম ও মুশফিকের রয়েছে তিনটি বিশকাপে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা। অংশগ্রহণকারী অন্যকোনো দলে এত বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতার সম্মিলন নেই। সাকিব, তামিম আর মুশফিক ২০০৭ থেকে টানা তাদের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন আর ২০১১ সালের ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে দলে জায়গা না পাওয়া মাশরাফি তার প্রথম বিশ্বকাপে খেলেছেলিন ২০০৩ সালে।
এই অভিজ্ঞদের সঙ্গ দেয়ার জন্য রয়েছে এক ঝাঁক সম্ভাবনাময় তরুণ ক্রিকেটার। সাতজন – মোস্তাফিজুর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন, লিটন দাস, আবু জায়েদ রাহি, মেহেদি হাসান, মোহাম্মহ সাইফুদ্দীন ও মোহাম্মদ মিঠুন – খেলতে যাচ্ছেন তাদের প্রথম বিশ্বকাপে। টুর্নামেন্টে পুরোনো সেনানীদের পাশপাশি নতুনদের ভেলকি দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটমোদীরা।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের প্রথম একাদশ নিয়ে। সাম্প্রতিককালে ওপেনিং জুটিতে তামিমের সঙ্গী হিসেবে দলে জায়গা দেয়া হচ্ছে সৌম্য সরকারকে। বিশ্বকাপের শুরুতে এর ব্যতিক্রম ঘটার সম্ভাবনা কম। কিন্তু কোনো কারণে যদি অসফল হয় এই জুটি বা ইনজুরিতে পরে যায় তাদের মধ্যে কেউ সেক্ষেত্রে দলে জায়গা করে নেবেন লিটন।
ওয়ান ডাউনে নামবেন অনেকের মতেই বাংলাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার সাকিব। এক উইকেট পরে যাওয়ার পরে ক্রিজে নেমে শুরুর দিকেই ইনিংসের লাগাম নিজের হাতে নিয়ে নেওয়া ও সিঙ্গেল, ডাবল নিয়ে রানার চাকা সচল রাখার গুরু দায়িত্ব এবার সাকিবের কাধেই বর্তাবে।
তারপরে একে একে নামবেন বাংলাদেশের ব্যাট হাতে সবথেকে বড় ভরসার প্রতীক মুশফিক। বিগত নিউজিল্যান্ড সিরিজে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান মিঠুন খেলবেন পাঁচ নম্বরে ও তারপর নামবেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান, মাহমুদুল্লাহ, যিনি গত বিশ্বকাপে পরপর দুই ম্যাচে ও ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শত রান করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পুরো বিশ্বে।
শেষের দিকে দ্রুত রান তোলার জন্য দলের প্রথম পছন্দ সাব্বির রহমান কিন্তু তার বিকল্প হিসেবে দলে রয়েছেন মাত্র ২৩-বলে উইন্ডিজ-এর বিপক্ষে অর্ধশতক করে বাংলাদেশকে আয়ারল্যান্ডের সদ্য সমাপ্ত ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়া মোসাদ্দেক হোসেন দলের একমাত্র স্পিনার হিসেবে রয়েছেন মিরাজ, যিনি কিনা ব্যাট হাতেও যথেষ্ট কার্যকর।
পেস বোলিং-এ বাংলাদেশের মূল ভরসা হচ্ছেন মোস্তাফিজ, যার সাফল্যের উপর বাংলাদেশের এই টুর্নামেন্টের ভাগ্য অনেকাংশে নির্ভর করছে। তার সঙ্গে থাকবে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী (২৬৫) বোলার মাশরাফি। এই দুইজনের সাথে থাকবেন অভিজ্ঞ রুবেল হোসেন অথবা তরুণ সাইফুদ্দিন। রুবেল হচ্ছে বাংলাদেশের দ্রুততম বোলার আর অন্যদিকে সাইফুদ্দিনের রয়েছে ব্যাট হাতে শেষের দিকে কিছু রান করার ক্ষমতা। তাই তাদের ভেতরে কে প্রথম একাদশে সুযোগ পাবেন তা পিচের কন্ডিশন ও দলীয় পরিকল্পনার উপর নির্ভর করবে। আর বিকল্প পেসার হিসেবে দলে রয়েছে রাহি, যাকে নেয়া হয়েছে একজন সুইং বোলার হিসেবে। ইংল্যান্ডের শীতল আবহাওয়ায় বল সুইং হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে মিরাজের বদলে চতুর্থ পেসার হিসেবেও দলে চলে আসতে পারেন রাহি।
প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে লিটনের অর্ধ শতকের পরে দলের কর্তা-ব্যক্তিরা এখন লিটনকে দলে রাখার প্রয়াস করতে পারেন। সেক্ষেত্রে দল থেকে বাদ পরে যাবে খুব সম্ভবত মিঠুন, সাকিবকে নেমে যেতে হবে ব্যাটিং অর্ডারে পাঁচ নম্বরে ও লিটন দখল করবে ওয়ান-ডাউন পজিশন।
রাউন্ড-রবিন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে নয়টি দলের বিপক্ষে খেলতে হবে টাইগারদের। ২ জুন থেকে তাদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু হবে আর তাদের প্রথম প্রতিপক্ষ শক্তিশালী সাউথ আফ্রিকা। তারপর ৫ তারিখে নিউজিল্যান্ড ও আট তারিখে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামতে হবে বাংলাদেশকে। অর্থাৎ টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম সপ্তাহে তিনটি শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলতে হবে তাদের। তাই প্রথম সপ্তাহটি মাশরাফিদের জন্য হতে যাচ্ছে এক অগ্নিপরীক্ষা।
বাংলাদেশের বর্তমান দলের সবথেকে বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে তাদের দলের মধ্যকার স্থিতিশীলতা যা এ টুর্নামেন্টের অনেক দলের মধ্যেই অনুপস্থিত। বাংলাদেশের রয়েছে এক অভিজ্ঞ ও চতুর অধিনায়ক মাশরাফি, বর্তমানে বিশ্বের সেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার সাকিব, ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ব্যাটিং গড়ের হিসেবে বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা ব্যাটসম্যান তামিম, পুরো বিশ্বকে নিজের কবজির মোচরে বোকা বানানো বোলার মোস্তাফিজ। এছাড়াও রয়েছে সৌম্য, লিটন, সাব্বিরের মত আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান যারা নিজেদের দিনে যেকোনো দলকে করে ফেলতে পারে ধরাশয়ী।
কিন্তু বাংলাদেশ দলে এখনো রয়ে গেছে কিছু প্রশ্নবোধক চিহ্ন। প্রথমত ইংল্যান্ডের এই বিশ্বকাপে যেখানে সবাই ধারণা করছে যে ৩০০-৩৫০ রান অহরহ হতে চলেছে সেখানে বাংলাদেশের জন্য প্রথম ইনিংসে ৩০০-এর অধিক রান করা বা সেটা তাড়া করে ম্যাচ জেতা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। নতুনেরা এখনো পুরোনোদের মত ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছে না যা চিন্তার ভাজ ফেলছে দলের হর্তাকর্তাদের কপালে।
এছাড়াও বোলিং-এ বৈচিত্রের অভাব স্পষ্ট। বাংলাদেশ উইন্ডিজের পর বিশ্বকাপে একমাত্র দল যাদের কোনো লেগ-স্পিনার নেই। সাব্বিরকে আমরা প্রস্তুতি ম্যাচ ও তার আগেও কিছু লেগ-স্পিন করতে দেখলেও সেটাকে লেগ-স্পিন কম আর ৯০কিমি/ঘন্টার গতির স্লো মিডিয়াম পেস বেশি বলে মনে হয়।
দলের মূল পাঁচ কান্ডারি প্রত্যেকেই নানান ইনজুরি থেকে মাত্র সেরে উঠেছেন আর তাদের মধ্যে কয়েকজন ছোট-খাটো ইনজুরি সামলেই খেলে চলেছেন। তাদের মধ্যে কেউ বা যদি একাধিক খেলোয়াড় আহত হয়ে পরে তাহলে তাদের যথার্থ রিপ্লেসমেন্ট বাংলাদেশের কাছে নেই।
তারপরও বাংলাদেশ এবার বিশ্বকাপে শুধুমাত্র কয়েকটি ম্যাচ জেতার লক্ষ্যে যাচ্ছে না। দর্শক ও খেলোয়াড়দের প্রত্যাশা এবারের বিশ্বকাপে আরো অনেক বেশি। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ইংল্যান্ডের মাটিতেই বাংলাদেশ চলে গিয়েছিল সেমি-ফাইনালে। এবারেও বাংলাদেশকে অন্তত সেমি-ফাইনালে দেখতে চায় তাদের সমর্থকরা। কিন্তু এবার শুধুমাত্র এক-দুটি বড় জয় দিয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়া সম্ভব হবে না, বাংলাদেশকে জিততে হবে পাঁচটি ম্যাচ বা নিদেনপক্ষে চারটি ও তারপর অপেক্ষা করতে নেট রান-রেটের হিসাবের।
ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপে আবহাওয়ায় খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারে কেননা ইংল্যান্ডের চিরচেনা বৃষ্টিতে ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে একাধিক ম্যাচ আবার বৃষ্টি আইনে পালটে যেতে পারে ম্যাচের পরিস্থিতি। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে হারতে বসা এক ম্যাচে বৃষ্টির কারণে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয় বাংলাদেশকে। সেই একটি পয়েন্ট পরবর্তীতে বাংলাদেশের সেমি-ফাইনালে যাওয়ার পথ সুগম করে। মাঠের নৈপুণ্য দেখানোর পাশাপাশি ভাগ্যের ছোঁয়া যদি বাংলাদেশের সাথে থাকে তাহলে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ উঠে যেতে পারে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন চূড়ায়।
এক নজরে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ দল: মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক), সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল খান, লিটন কুমার দাস, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ মিঠুন, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মুশফিকুর রহিম, মোস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, সাব্বির রহমান, আবু জায়েদ চৌধুরী রাহী, সৌম্য সরকার ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত।
একনজরে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পরিসংখ্যানঃ
মোট ম্যাচ: ৩২
জয়: ১১
পরাজয়: ২০
টাই: ০
ফলাফল হয়নি: ১
সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর: ৩২২-৪ (বিপক্ষ স্কটল্যান্ড) নেলসন ২০১৫
সর্বনিম্ন দলীয় স্কোর: ৫৮ (বিপক্ষ সাউথ আফ্রিকা) ঢাকা ২০১১
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক: সাকিব আল হাসান (২১ ইনিংসে ৫৪০ রান)
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক: সাকিব আল হাসান (২১ ম্যাচে ২৩ উইকেট)
সর্বোচ্চ সাফল্য: কোয়ার্টার-ফাইনাল (২০১৫)