আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, যখন আপনার ১৬ বছর বয়স ছিল তখন কি করছিলেন আপনি? স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, নাকি বন্ধুদের সাথে আড্ডা, খেলায় মশগুল ছিলেন। একবার ভেবে দেখুন তো মাত্র ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে যদি বলিউডের এক বিখ্যাত পরিচালক ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিকের এক অমর সৃষ্টি নিয়ে নির্মিতব্য চলচ্চিত্রে বিশ্বসুন্দরী ও সিনেমা জগতের অন্যতম বড় এক তারকার জন্য পর্দায় গান করতে বলা হয় সেটি তার জন্য কত বড় একটি ঘটনা ! ঠিক এভাবেই বলিউডের রঙিন জগতে প্রথমবারের মত পদার্পণের সুযোগ পান শ্রেয়া ঘোষাল। ১৬ বছর বয়সে যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে তিনি সুযোগ পেয়ে যান হিন্দি সিনেমায় গান করার, সেই একই মুগ্ধতা এখনও ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। আজকে এই কোকিলকন্ঠী গায়িকার জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরব আপনার সামনে।
জন্মঃ
১৯৮৪ সালের ১২ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শ্রেয়া। তাঁর পূর্বপুরুষেরা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের হাসাড়া গ্রামের অধিবাসী । জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও তিনি বেড়ে ওঠেন রাজস্থানের কোটার কাছে রাওয়াতভাতা শহরে। তাঁর বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষাল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের একজন প্রকৌশলী আর তাঁর মা শর্মিষ্ঠা ঘোষাল ছিলেন সাহিত্যের ছাত্রী।
শ্রেয়া রাওয়াতভাতা ও মুম্বাইয়ের অণুশক্তিনগরে অ্যাটমিক এনার্জি সেন্ট্রাল স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরে সেখান থেকে মুম্বাইয়ের এস আই ই এস কলেজে ভর্তি হন।
হাতেখড়িঃ
শ্রেয়ার সংগীতের প্রথম শিক্ষক ছিলেন তার মা। চার বছর বয়স থেকেই শ্রেয়া তাঁর মার কাছে হারমোনিয়াম বাজানো শেখা শুরু করেন । পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় আধুনিক সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন । জিটিভির ‘সা রে গা মা পা’ সঙ্গীত প্রতিযোগিতার শিশুদের বিশেষ পর্বে অংশগ্রহণ করেন শ্রেয়া। সেই প্রতিযোগিতায় তিনি জয়ী হোন আর সেই সময়ে অনুষ্ঠানের একজন বিচারক বিখ্যাত সুরকার কল্যাণজী বীরজী শাহ’র নজর কাড়েন । তাঁর পরামর্শেই শ্রেয়া পরিবারসহ মুম্বাইয়ে চলে আসে ও সেখানে কল্যাণজীর কাছে দেড় বছর সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
বলিউডে পদার্পণঃ
শ্রেয়া দ্বিতীয়বারের মত ‘সা রে গা মা পা’ প্রতিযোগিতায় যখন অংশগ্রহণ করেন তখন তার কন্ঠ বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালির মায়ের খুব পছন্দ হয়। তৎক্ষণাৎতিনি তার ছেলেকে এই মেয়েকে তার কোনো চলচ্চিত্রে সুযোগ করে দিতে বলেন। সঞ্জয়ও রাজি ছিলেন মায়ের প্রস্তাবে, কিন্তু বিপত্তি তখন বেঁধে যায় যখন সঞ্জয়ের মা শ্রেয়ার নাম ভুলে যান। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সঞ্জয়কে খুঁজে বের করতে হয় শ্রেয়াকে। আর তারপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাস ‘দেবদাস’-কে নিয়ে নির্মিতব্য ছবিতে পারুর কন্ঠে গান গাওয়ার জন্য তাকে সুযোগ দেয়া হয়। সেই ছবিতে পারু অর্থাৎ পার্বতীর চরিত্রে অভিনয় করছিলেন ঐশ্বরিয়া রায়। ২০০২ সালে ছবিটি বের হয় আর ছবিটির গানগুলো সেই সময়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে।
ছবিটিতে শ্রেয়া পাঁচটি গানে কন্ঠ দেন।‘ডোলা রে’ গানটিতে কন্ঠ দেওয়ার জন্য কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সাথে যৌথভাবে সঙ্গিট শিল্পীদের জন্য চরম আরাধ্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান তিনি। কিন্তু সেই বছরই আরো বড় এক পুরস্কার তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই ছবিতে তার একক গান ‘ব্যারি পিয়া’ গানটির জন্য তিনি লাভ করেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০৩ সালে তিনি নতুন সঙ্গীত মেধা হিসেবে ফিল্মফেয়ার আর. ডি. বর্মন পুরস্কারও ঘরে তোলেন।
সিংহাসনে আরোহণঃ
দেবদাস-এর পর থেকে আর একবারের জন্যও শ্রেয়াকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর সাফল্যের পালক তার মুকুটে যুক্ত হতে থাকে। এক এক করে সিড়ি ভেঙ্গে তিনি পৌছে যান সাফল্যের শীর্ষ আসনে। তার পুরস্কারের সুদীর্ঘ তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার চারবার (২০০৩, ২০০৬, ২০০৮, ২০০৯); ফিল্মফেয়ার পুরস্কার চারবার (২০০৩, ২০০৪, ২০০৮, ২০০৯); আইফা অ্যাওয়ার্ড সাতবার (২০০৩, ২০০৪, ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪)।
হিন্দির পাশাপাশি বাংলা, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, মালায়লাম, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষার চলচ্চিত্রেও গান করেছেন শ্রেয়া আর তার জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার।
শুধু ভারত নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়ার ভক্তরা। তার প্রমাণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্য, যেখানে ২০১০ সাল থেকে ২৬ জুনকে ‘Shreya Ghoshal Day‘ বলে উদযাপন করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি ২০১৩ সালের এপ্রিলে লন্ডনের ‘হাউস অফ কমন্স’-এ তাকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়।
২০১৫ সালে নিজের বাল্যকালীন বন্ধু শিলাদিত্য মুখোপাধ্যায়-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন শ্রেয়া।
এখন ভারতের নানা ভাষার চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পাশাপাশি, নিজের একাধিক অ্যালবাম ও বিশ্বের নানা প্রান্তে কনসার্ট করে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন শ্রেয়া। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সংগীতের এমন চূড়ায় তিনি পৌছে গেছেন যেখানে যাওয়ার স্বপ্নও খুব কম মানুষ দেখতে পারে। এভাবেই সারাজীবন তিনি গেয়ে যাবেন নিজের কিন্নর কন্ঠে হাজারো গান আর তার সুরের মূর্ছনায় শ্রোতাদের আরো মুগ্ধ করে চলবেন এই আশাই ব্যক্ত করছি।