প্রাগৈতিহাসিক কালে আমাদের এই পৃথিবীতেই পদচারণা ছিল বিশালদেহী ডাইনোসরদের। এখন ভাবতে অবাক লাগলেও একসময়ে তারাই রাজত্য করত আমাদের পৃথিবীকে। শুধু স্থলে নয়, জলেও অবস্থান ছিল এসব দৈত্যাকার জন্তুদের। কিন্তু আজ শুধু তাদের স্মৃতির শেষ চিহ্ন হিসেবে টিকে রয়েছে তাদের ফসিল, যার অধিকাংশ লুকিয়ে রয়েছে ভূমির গভীরে। তবে একদল মানুষ এখনো আছে যারা বিশ্বাস করে বর্তমান পৃথিবীতেও বিশেষ বিশেষ কিছু স্থানে বেঁচে আছে সেসব ভয়ঙ্কর দানবরা। এই মতানুসারীদের মতে সেরকমই এক দানব লুকিয়ে আছে স্কটল্যান্ডের লক নেস হ্রদে আর তার নাম হচ্ছে নেসি।
লক নেস-এর জল দানবের কথা প্রথম দেখা যায় ৭ম শতাব্দীতে এক আইরিশ খ্রিষ্টান ধর্ম যাজক সেইন্ট কলম্বিয়ার লেখনীতে। তার জীবনীতে তিনি লিখে যান যে রাজার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় যাত্রাপথে তিনি হ্রদের ধারে দেখেন এক বিশাল দানব এক মানুষকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল। তিনি সেই দানবকে আদেশ করেন আবার হ্রদে ফিরে যেতে আর কোনো মানুষকে কখনো ক্ষতি না করতে আর দানবটি তখনই পানিতে ফিরে যায় এবং আর কখনো কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। এরকমই এক অতিরঞ্জিত, কল্পকথা থেকে শুরু হয় লক নেস-এর জল দানবের গল্প।
১৯৩৩ সালে লক নেস হ্রদের এই জলদানবের গল্প প্রথম হাওয়া পায় যখন হ্রদের পাশ দিয়ে তৈরি করা নতুন রাস্তায় গাড়ি দিয়ে চলার সময় এক দম্পতি দাবি করে যে তারা এক বিশালদেহী প্রাণীকে লেকের ধারে বসে থাকতে ও পরে লেকে চলে যেতে দেখেছেন। এই খবরটি ছাপা হয় ‘Inverness Courier’ নামের পত্রিকায়।
খবর ছড়িয়ে পরলে লন্ডন থেকে ব্রিটিশ সাংবাদিকেরা আসেন সেই রহস্যময় প্রাণীর খোঁজে। ‘Daily Mail’ পত্রিকার অনুসন্ধানকারী দাবি করেন যে তিনি এক বিশাল প্রাণির পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন লেকের ধারে। কিন্তু সেই পায়ের ছাপের ছবিগুলো যখন British Natural History Museum-এ পাঠানো হয়ে তখন সেখানকার গবেষকরা সেই পায়ের ছাপকে বানোয়াট বলে ঘোষণা করেন।
তারপরও নেসিকে নিয়ে উৎসাহে ভাটা পরেনি সাধারণ মানুষদের, তারা সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন সেই দানবকে খুঁজতে। ১৯৩৪ সালের ২১ এপ্রিল Daily Mail’ পত্রিকায় রবার্ট কেনেথ ওয়িলসন নামের এক ব্রিটিশ ডাক্তারের তোলা একটি ছবি প্রকাশ করে দাবি করা হয় এটি হচ্ছে লক নেস দানবের ছবি। সেই ছবিটি দেখে মনে হয় একটি বিশালাকৃতির দানব পানির মধ্য থেকে মাথা ও ঘাড় বের করে আছে।
সেই ছবিটি প্রকাশের পর দানবের কাহিনিতে বিশ্বাসীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকে দাবি করেন যে মানুষদের ধোকা দেয়ার জন্য এটি আরেকটি বানোয়াট ছবি কিন্তু তাদের কথাকে গ্রাহ্য না করে মানুষেরা লক নেস দানবের গল্পে আরো বাতাস দেয়া শুরু করল।অনেকে ছবিটিকে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগেই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাওয়া ‘Plesiosaurus‘ প্রজাতির জলে বাস করা ডাইনোসরের অনুরূপ মনে করে।
কিন্তু ১৯৯২ সালে এসে প্রমাণিত হয় যে ছবিটি আসলে বানোয়াট ছিল, কিন্তু ততদিনে লক নেস দানবের অস্তিত্ব নিয়ে আরো অনেক জলঘোলা হয়ে গেছে।
১৯৬০ সালে লক নেস হ্রদে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে হ্রদে অভিযান চালায় কিন্তু কোনোকিছু খুঁজে পায় না। তারপর ১৯৭৫-এ আমেরিকার বোস্টান শহরের একদল গবেষকেরা একইসাথে শব্দ তরঙ্গ ও পানির গভীরে ছবি তোলার প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এক অভিযান চালায় যেখানে তারা ‘Plesiosaurus’-এর পাখনার মত দেখতে কোনো একটি বস্তুর ছবি তুলতে পারে। কিন্তু তা সেটি আসলেই কোনো দানবের ছবি না অন্যকিছু তা প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি। ৮০ আর ৯০ দশকেও এরকম আরো অনেক অভিযান পরিচালিত হয় কিন্তু কোথা থেকেই শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
সাম্প্রতিককালে ইকো প্রযুক্তি ব্যবহার করে লক নেসের তলদেশে বিশাল এক গুহা বা খাদ আছে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। সেই খাদের মধ্য দিয়েই নেসি সমুদ্র থেকে হ্রদে ও পরে আবার সমুদ্রে ভ্রমণ করতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
গবেষকরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই রহস্যের সমাধান বের করতে। কিন্তু লক নেস হ্রদের এই দানবের কাহিনিগুলোকে ব্যবহার করে সেখানকার কর্তৃপক্ষ হ্রদটিকে বানিয়ে তুলেছেন একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। প্রতিবছর হাজারো মানুষ ভ্রমণ করে এই হ্রদে লক নেস দানবের দেখা পাবার আশায়। হ্রদে ভেসে থাকা কোনো গাছের কান্ড বা স্রোতের ধারাকেই দূর থেকে দেখে তাকে জলদানব মনে করার ঘটনা সেখানে দেখতে পাওয়া যায় অহরহ।
১৫০০ বছর আগের কোনো এক প্রাণীর উত্তরসূরি অথবা মানুষের মস্তিষ্কের উর্বর কল্পনা হচ্ছে আজকের নেসি। সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন আধুনিক যুগেও পৃথিবীর বুকে এক অপার রহস্য হয়ে বেঁচে আছে জলদানব নেসি।