ওঙ্কার
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশকালঃ ১৯৭৫
প্রকাশকঃ স্টুডেন্ট ওয়েজ
অতীত ঐশ্বর্য নিয়ে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধ, নতুন বাস্তবতায় টিকে থাকার চেষ্টায় এক যুবক এবং ভাগ্যের গেরাকলে সেই যুবকের সাথে দাম্পত্যের বাঁধনে বাধা এক বোবা মেয়ে; এদেরকে নিয়েই রচিত হয়েছে আহমদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’।
গল্পের প্রথমেই আমরা পরিচিত হই পুরোনো জৌলুসের গৌরবে অন্ধ এক বয়স্ক ব্যক্তির সাথে। অতীতকে আকড়ে ধরে রাখা এই ব্যক্তির চোখে অন্য গ্রামবাসীরা এখনো তার প্রজা এবং সে তাদের প্রভু। কিন্তু তার চাপিয়ে দেয়া দাসত্বকে আর মেনে নিচ্ছে না অন্যরা। এসব অবাধ্য প্রতিবেশীদের হেনস্তা করার জন্য তিনি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে বেড়ান। আর এই কাজে তার প্রধান সহযোগী ছিলেন আবুনসর মোক্তার। কিন্তু নিজের একসময়ের এই ভৃত্যের কাছেই মামলায় হেরে গিয়ে তিনি হয়ে যান সর্বস্বান্ত।
আইয়ুব খানের সেনা সমর্থিত সরকারের এক বিশেষ অনুগত হিসেবে পরিচিত আবুনসর তার একসময়ের প্রভুকে ঋণের দায় থেকে মুক্তি ও তার পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার বিনিময়ে একটি কাজ করতে হবে। নিজের ছেলেকে মোক্তার সাহেবের বোবা মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে হবে। অসুস্থ বাবা-মা, আর নিজের ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিয়েতে রাজি হয়ে যায় ছেলেটি। বিয়ে হয়ে তাদের মধ্যে আর বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তালুকদার ও তার স্ত্রী ইহলোকের পাঠ চুকিয়ে দেন।
বোবা স্ত্রী আর ছোট বোনকে নিয়ে শহরে চলে আসে ছেলেটি। বোবা মেয়েটি নিজের সর্বসত্ত্বা দিয়ে চেষ্টা করে স্বামীর মন জয় করতে। কিন্তু স্বামীর কাছে নিজের স্ত্রীর নির্বাক উপস্থিতি স্বীয় অক্ষমতা ও অসহায়ত্বকে জানান দিতে থাকে।
কিন্তু ছেলেটির এই রুক্ষ মনোভাব একসময় পালটে যায়। স্ত্রী ও ছোট বোনকে নিয়ে এক ছোট্ট, সুন্দর, গোছানো সংসারে ভালোই কাটতে থাকে তাদের দিনগুলো। কিন্তু তাদের শান্তির জীবনে এবার বাগরা দেয় আইয়্যুব বিরোধী আন্দোলন।
সংবাদপত্রে, অফিসে, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে সব জায়গাতে একই ফিসফিসানি। এবার বোধ হয় পতন হতে যাচ্ছে আইয়ুব খানের। ভালো লাগে না এসব কথা ছেলেটির কাছে। ছেলেটির ভেতরের স্বাধীনতার চেতনা তখন ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের আড়ালে ঢাকা। নিজের সুন্দর মসৃণ জীবনের জন্য মুক্তির চেয়ে তার সামরিক শাসনের ক্রীড়নক হিসেবে থাকাই শ্রেয়। কিন্তু সমাজের এত প্যাচ থেকে আলাদা বোবা মেয়েটি যাচ্ছিল স্বামীর ঠিক ভিন্ন পথে।
নিজের বাসাতে জানালার গ্রিলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সে শুনতে থাকে আন্দোলনরত মানুষের শ্লোগান ‘বাংলাদেশ’। মুখ ফুটে বলতে না পারলেও এই শ্লোগানকে সে মনে ধারণ করে নেয়। মিছিলের সাথে তাল মিলিয়ে সেও বলতে চায় ‘বাংলাদেশ’। কিন্তু নিজের অক্ষমতার কাছে সে বারবার পরাস্ত হয়। কিন্তু তার চেষ্টা সে থামায় না।
লেখকের চোখে সমগ্র বাংলাদেশ ছিল তখন সেই বোবা মেয়েটির মত। বছরে পর বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভকে উগড়ে দেয়ার জন্য ছটফট করছিল সে। সে জানত যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে রক্ত বিসর্জন করতে হবে, তার নিজের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে, কিন্তু না, তারপরও সে থেমে থাকে নি। স্বাধীনতার নেশায় সে এতটাই মত্ত যে তখন বাকি সবকিছু তার কাছে উহ্য।
লেখক আহমদ ছফা উপন্যাসটিতে একাধিক চরিত্রের কোনো নাম দেননি। মাত্র ৩৪ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে সব বাহুল্যকে উহ্য রেখে সেই সময়কার অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার মানসিকতাকে প্রতিকী রূপে সেইসময়ের কিছু মানুষের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
আহমদ ছফার সাহিত্য জীবনের অন্যতম সেরা এই উপন্যাসটি পড়ে দেখতে পারেন। আশা করছি আপনাদের সময় বিফল যাবে না।