কাগজে কলমে ১৯৪৭ সালকে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের বছর এবং ভারত ও পাকিস্তান নামের ২টি নতুন স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের বছর হিসেবেই মনে রাখি। কিন্তু এসকল তথ্যের আড়ালে আরো যে কত অসংখ্য অজানা কথা লুকিয়ে রয়েছে পর্দার আড়ালে তা বেশিরভাগ সময়ই তা এড়িয়ে যায় আমাদের দৃষ্টি। ভারতের শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন যখন গান্ধী, জিন্নাহদের সাথে ভারতের স্বাধীনতার রুপরেখা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িত, ঠিক সেই সময় এক অবাক করা, বিতর্কিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন-এর সহধর্মিণী এডুইনা মাউন্টব্যাটেন-এর মাঝে।
তাদের এই সম্পর্কের কোনো নাম ছিল না, সত্যি বলতে তাদের সম্পর্কের আসল পরিচয় ইতিহাসবেত্তারাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে এই সম্পর্ক নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে যায় নি, আরো বেড়েছে।
ভারতবর্ষের কিছুসংখ্যক ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস যে নেহেরুকে নিজের আয়ত্তে রাখার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর স্ত্রীকে ব্যবহার করেছেন। আবার অনেকের কাছে এটা দুই সমচিন্তার নিঃসঙ্গ মানুষের মাঝে গড়ে ওঠা এক অমায়িক বন্ধন মাত্র।
আসল সত্য যাই হোক না কেন, ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি, ভারত বিভাজন ও পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের আড়ালে চলতে থাকা এই সম্পর্ক এখনো সবার চিন্তার উদ্রেক করছে।
এ সম্পর্কটা বুঝতে হলে সম্পর্কের ব্যক্তি দুজনকে কাছ থেকে বুঝতে হবে। তাদের ব্যক্তিত্ব, শৈশব, পরিবার, সন্তান, বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে জানতে হবে।
প্রথমে জেনে নেই জওহরলাল নেহেরুর সম্পর্কে। জওহরলাল নেহেরুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ সালে। খুবই ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারে তাঁর জন্ম। তার বাবা একজন আইনজীবী ছিলেন। জওহরলাল নেহরু অধ্যয়ন করেছিলেন ব্রিটেনের ইটন আর কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯১৬ সালে কমলা নামের এক উচ্চবংশীয় মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। বিয়ের কিছুদিন পরেই দুজনই বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা আসলে ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ। ১৯৩৬ সালে, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে, কমলা টিউবারকুলেসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে নেহেরু আর বিয়ে করেননি।
এবার নজর দেই এডুইনা এশলি মাউন্টব্যাটেন-এর জীবনে। ১৯০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এডুইনা। তাঁর পরিবারের সাথে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পদের উত্তরাধিকারী ছিলেন এডুইনা। তাঁকে ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ সুন্দরি মহিলাদের একজন বলে মনে করা হত।
১৯২২ সালে তিনি বিয়ে করেন ২১ বছর বয়সী লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেনকে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাকে খুব ভালবাসতেন। কিন্তু এডুইনার বিলাসীতা এবং উঁচু রুচিবোধের সাথে পেরে উঠতে পারেননি তিনি। তাই তাদের দাম্পত্য জীবন প্রথম থেকেই নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। সম্পর্কটা আরও স্তিমিত হয়ে যায় যখন তাদের প্রথম সন্তান প্যাট্রিসিয়া জন্মায়। একসময় দুইজনই একে অন্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
এডুইনা একাধিক পরকিয়ার সম্পর্কে লিপ্ত হোন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে অবহিত ছিলেন এবং এসব সম্পর্কে তাঁর মৌন সম্মতিও ছিল। তিনি নিজেও একাধিক পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলেন। এডুইনার একাধিক শয্যাসঙ্গীর জন্য কন্যা পামেলা মাউন্টব্যাটেন তাঁকে ‘A man eater‘ বলে সম্বোধন করেছেন।
১৯৪৭ সালে ভারতের শেষ ভাইসরয় হিসেবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর পরিবারসহ ভারতে আসেন। তাঁর উপর দায়িত্ব ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা করে ভারতের স্বাধীনতার রুপরেখা তৈরি করা। আর তাই তাঁর আগমণের পর থেকেই তাঁর বাসভবনে গান্ধী, জিন্নাহ, নেহেরুদের মত শীর্ষ নেতাদের আসা-যাওয়া চলতে থাকে। সেইসময় এডুইনার সাথে নেহেরুর সাক্ষাৎ হয়। যদিও এর আগে সিঙ্গাপুরে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল, এবারের সাক্ষাতের পরেই তাদের মধ্য হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বলা হয়ে থাকে যে সেসময় নেহেরুর পান্ডিত্য এবং প্রজ্ঞায় এডুইনা বিমোহিত হয়ে যান। নেহেরুর একাকিত্বের জীবনে এডুইনা নতুন গতির সঞ্চার করেন । এভাবেই একসময় তাদের এই সম্পর্ক একসময় যেন বন্ধুত্বকে ছাড়িয়ে যেন আরো বেশি কিছু হয়ে পরে।
এডুইনার ছোট মেয়ে পামেলা হিকস-এর বয়স তখন আঠারো। ২০১২ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময়ে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ‘Daughter of Empire: Life as a Mountbatten’ বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি তাঁর মা ও নেহেরুর মাঝের সম্পর্ক নিয়েও বিশদভাবে আলোচনা করেন। তাঁর মতে এডুইনা ও পণ্ডিত নেহরু একে অপরকে অবশ্যই গভীরভাবে ভালবাসতেন কিন্তু তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা প্রচলিত অর্থে পরকিয়া প্রেমের ছিল না। তাঁর ভাষ্যমতে,
“পণ্ডিতজির মধ্যে ব্যতিক্রমী সাহচর্য খুঁজে পান মা। বোধের যে স্তরে মা পৌঁছতে চেয়েছিলেন, তা উনি নেহরুর মধ্যে পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তবে কখনওই তা ‘শারীরিক সম্পর্ক’ পর্যন্ত গড়ায়নি।”
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্তটি যখন এল, ততদিনে তিনি মাউন্টব্যাটেন পরিবারের গভীর বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। লেডি হিকসের কথায়,
‘অসাধারণ চমৎকার কন্ঠস্বর, আর তেমনই বাগ্মিতা। তাঁর সঙ্গ ছিল সবার প্রিয়, আর ক্যারিশমা ছিল সাংঘাতিক। আমরা মার্চের শেষে ভারতে গেলাম, আর মাত্র মাস পাঁচেকের মধ্যেই আমরা সবাই পন্ডিতজিতে মুগ্ধ !’
কিন্তু লেডি হিকস খুব পরিষ্কার করেই বারবার বলেছেন যে নেহরু আর এডুইনার প্রেম ছিল যৌনতার ঊর্ধ্বে।
‘দুজনের জীবনে ঠিক যে জিনিসগুলোর অভাব ছিল, তারা পরস্পরের ঠিক সেই অভাবগুলোই মিটিয়ে দিলেন। দুটো নি:সঙ্গ মানুষের জীবন কাছাকাছি এল, যেন একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল দুজনের মাঝে।আজকাল তো সব কিছুই তো এসে ঠেকে যৌনতায়! দুটো মানুষ পরস্পরকে ভীষণ আবেগ দিয়ে ভালবাসেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও যৌন সম্পর্ক নেই – আজকের প্রজন্মের কাছে সেটা অদ্ভুত লাগতে পারে।’
লেডি হিক্সের ভাষ্যমতে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে যখন তাদেরকে আবারো নিজদেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হয়, যা মায়ের জন্য তা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। যাওয়ার আগে লেডি মাউন্টব্যাটেন নেহেরুকে একটি পান্নার আংটি উপহার দিতে চেয়েছিলেন, কারণ স্বাধীনতা আন্দোলনের ততদিনে নেহেরু তাঁর পৈত্রি সম্পত্তির এক বড় অংশ ব্যয় করে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি জানতেন যে নেহেরু কখনোই এরকম কোনো উপহার গ্রহণ করবেন না। তাই নেহেরুর কন্যা ইন্দিরাকে সেই আংটিটি উপহার দিয়ে তিনি বলে যান যে কখনো যদি নেহেরুর অর্থসংকট হয় তবে সেই আংটিটি বিক্রি করে নেহেরুকে সে অর্থ দিয়ে যেন ইন্দিরা সাহায্য করে।
ভারত ছাড়ার পরে আরো বারো বছর বেঁচে ছিলেন এডুইনা। এই বারো বছরে নেহেরুর সাথে তাঁর চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় থাকে।
১৯৬০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মারা যান এডুইনা মাউন্টব্যাটেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী লেডি মাউন্টব্যাটেনকে সমাহিত করা হয়েছিল সমুদ্রের বুকে। সেসময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহেরু। লেডি মাউন্টব্যাটেনকে শেষ বিদায় জানাতে নেহরু পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি রণতরী।
এডুইনার মৃত্যুর ৪ বছর পরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন জওহরলাল নেহেরু।