শচীন দেববর্মণ, যিনি এস.ডি. বর্মণ নামে ভারতে অধিক পরিচিত, হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনালগ্নের এক বিখ্যাত সংগীত পরিচালক, সুরকার ও গায়ক। ধ্রুপদী সংগীত ও লোকগীতির সমন্বয়ে তিনি সৃষ্টি করেন সংগীতের এক ভিন্ন ধারার। তাকে মনে করা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালকদের পথপ্রদর্শক। আর ভারতীয় সংগীত জগতের এই নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশে।
শচীন দেববর্মণ ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবরে কুমিল্লায় ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ ও মা নিরূপমা দেবী দম্পতির মোট লয়জন সন্তান ছিল। তাদের পাঁচ পুত্রের মধ্যে শচীন ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শচীন দেববর্মণ কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ১৯২০ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ২ বছর পর আই এ পাস করে একই কলেজে আবার বি এ ক্লাসে ভর্তি হন তিনি। ১৯২৪-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন তিনি।
শিশু বয়স থেকেই শচীন-এর সংগীতে তালিম শুরু হয়। তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিল বাবা নবদবীপ চন্দ্রদেব, যিনি কিনা ছিলেন একজন দক্ষ সিতার বাদক ও ধ্রুপদী গায়ক। ১৯২৫ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃষ্ণ চন্দ্র দে-এর কাছে তালিম নেন। তারপর একে একে তিনি বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত সারেঙ্গী বাদক খলিফা বাদল খান, মহান সরোদবাদক আলাউদ্দিন খাঁ-এর কাছ থেকে সংগীতের তালিম নেন।
১৯৩১ সালে শচীনের পিতা নবদ্বীপচন্দ্র ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় পরলোকগমন করেন। শচীন দেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। তাঁর সামনে সুযোগ ছিল ত্রিপুরায় থেকে যেয়ে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি করে রাজসিকভাবে জীবন যাপন করার। কিন্তু সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণে আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে সংগীত নিয়েই যুদ্ধ করার জন্য নেমে পড়লেন তিনি।
“পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তাই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।”
নিজের আত্মজীবনী ‘সরগমের নিখাদ‘-এ বলেছেন শচীন দেববর্মণ।
১৯২৩ সালে থেকে রেডিওতে গান করে আসলেও, ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে। তাঁর প্রথম রেকর্ডকৃত দুটি গান হল পল্লীগীতির ঢঙে গাওয়া “ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে” ও “এ পথে আজ এসো প্রিয়”। ১৯৩০-এর দশকে রেডিওতে তাঁর গাওয়া পল্লীগীতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
৩০-এর দশকে একজন সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন শচীন। বাংলা থিয়েটারে সংগীত পরিচালনা করে নিজের হাত ঝালিয়ে নিয়ে ১৯৩৭ সালে ‘রাজগী’ ছবিতে সিনেমাজগতে সংগীত পরিচালক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। তারপর থেকে ৪০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন তিনি। তারপর পালা ছিল হিন্দি সিনেমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা।
১৯৪৪ সালে হিন্দি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করার জন্য তিনি পাড়ি দেন মুম্বাইতে। ১৯৪৬ সালে অশোক কুমারের ‘শিকারি’ ও ‘আঠ দিন’ ছবিতে কাজ করে হিন্দি ছবিতে শচীনের পথচলা শুরু হয়। তারপর থেকে একইসাথে হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রে কাজ করতে থাকেন শচীন।
বাঙালি গায়ক ও অভিনেতা কিশোর কুমারের সাথে এক দারুণ যুগলবন্দী গড়ে ওঠে শচীন দেববর্মণের। দুইজনের হাত ধরে ‘নো দো গেয়ারা’, ‘মুনিমজী’ ও ‘প্রেম পূজারী’-এর মত অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার পায় শ্রোতারা। তাঁর সংগীতের এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল পর্দার চরিত্রদের আরো প্রাঞ্জল করে দেয়ার। গুরু দত্ত, দেব আনন্দ ও বিমল রায়-এর মত শিল্পীরা তাঁর এই প্রতিভাকে ধরতে পেরেছিল। তাই তাদের চলচ্চিত্রের সংগীত আয়োজনের জন্য তাদের প্রথম পছন্দ ছিল শচীন দেববর্মণ।
শচীনের কাছে গানের তালিম নিতেন মীরা দাসগুপ্ত নামের একজন গায়িকা। সংগীত সাধনার ফাঁকে দুইজনের মাঝে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তারা। মীরা মানী পরিবারের সন্তান হলেও শচীনের মত কোনো রাজপরিবার থেকে ছিলেন না। তাই এই বিয়েতে শচীনের পরিবারের ছিল ঘোর আপত্তি। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে, মীরাকে বিয়ে করলে শচীনকে রাজপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে এবং সম্পত্তি থেকে তাকে বেদখল করে ফেলা হবে। তারপরও শচীন সম্পত্তির অধিকারকে ত্যাগ করে বিয়ে করেন মীরাকে ১৯৩৭ সালে এবং ২ বছর পর তাদের কোলে জন্ম নেয় আরেক বিখ্যাত সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মণ, যিনি এখন আর. ডি. বর্মণ নামেই অধিক পরিচিত।
শচীন দেববর্মণের পরিচালনায় লতা মঙ্গেশকর একাধিক কালজয়ী গান গেয়েছেন। লতা শচীন দেববর্মণের একজন প্রিয় পাত্র ছিলেন। কিন্তু ১৯৫৭ সালে একটি গানের রেকর্ডিং-এর সময়ে সৃষ্ট বিতণ্ডায় শচীন লতার উপর এতটাই রুষ্ট হয়ে যান যে তিনি পণ করেন যে আর কখনো লতাকে দিয়ে গান করাবেন না। লতার স্থলাভিষিক্ত হয় তারই ছোট বোন আশা ভোসলে। আশা ভোসলেই পরবর্তীতে পুত্রবধূ হিসেবে শচীন বর্মণের ঘরে প্রবেশ করে।
শচীন দেববর্মণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ফুটবলের প্রতি তার প্রেম। কলকাতা ফুটবলের বড় দল ইস্ট বেঙ্গলের পাড় ভক্ত ছিলেন তিনি। বাদ দিতেন না একটি ম্যাচও। দল জিতলে তার খুশি যেন কোনো বাধ মানত না। কিন্তু দল যখন হেরে যেত, বিশেষ করে সে হার যদি হত প্রবল প্রতিদ্বন্দী মোহনবাগানের বিপক্ষে তখন ভেঙ্গে পরতেন শচীন। ক্ষোভে, দুঃখে খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিতেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ‘মিলি’ ছবির গান রেকর্ডিং-এর সময় হঠাৎ করে প্যারালিটিক অ্যাটাক হয় শ্চীনের। তারপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শচীন আর শয্যা ছেড়ে উঠতে পারেননি। শচীন যখন হাসপাতালে অচেতন হয়ে শুয়ে ছিল তখন তার দল ইস্ট বেঙ্গল মোহনবাগানকে ৫-০ ব্যবধানে হারিয়ে দেয়। পুত্র রাহুল দেববর্মণ দলের জয়ের কথা উচ্চস্বরে বলতে থাকে বাবা শচীনকে। দলের জয়ের কথা শুনে শচীন তখন জীবনে শেষবারের মাথা তুলে তাঁর পুত্রের দিকে তাকান। তারপর আবার অচেতন হয়ে পরেন।
১৯৭৫-এর ৩১শে অক্টোবর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শ্চীন দেববর্মণ। তিনি আমাদেরকে ছেড়ে গিয়েছেন ৩ দশকের অধিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার গান এখনো আগের মতই মানুষের হৃদয়ে জায়গা ধরে রেখেছে। তাঁর গানের মাধ্যমেই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।