লতা মঙ্গেশকর উপমহাদেশের সংগীত জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। ১৯৪০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া সংগীত জীবনে তিনি ৩৬টি ভাষায় ১ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। তাঁর কন্ঠের ভক্ত না এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে।
নিজের গান দিয়ে অগণিত মানুষের হৃদয় জিতে নেয়া এই গায়িকার জীবনের কিছু অজানা কথা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
১. একদিনের স্কুলজীবনঃ
লতা মঙ্গেশকর তাঁর জীবনে শুধু একদিনের জন্যই স্কুলে গিয়েছেন। কথিত আছে স্কুলে নিজের ছোট বোন আশা ভোসলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন লতা। তারপর ক্লাসের মধ্যেই নিজের সহপাঠীদের গান শেখানো শুরু করেন তিনি। স্কুলের শিক্ষকরা এ কারণে তাকে শাসন করলে অভিমান করে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন লতা।
২. ‘অতিরিক্ত চিকন কন্ঠ’-র কারণে প্রত্যাখ্যানঃ
নিজের কিন্নর কন্ঠের জন্য বিখ্যাত লতাকে তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে এই কন্ঠের জন্যই প্রত্যাখ্যান হতে হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দার তাঁকে পরিচয় করে দেন বলিউড ছবির প্রযোজক শশধর মুখার্জীর সাথে। কিন্তু তাঁর কাছে লতার কন্ঠ ‘অতিরিক্ত চিকন’ মনে হওয়ায় লতাকে কাজ দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এ শুনে ক্ষুব্ধ গোলাম হায়দার তাঁকে বলেছিলেন যে একদিন প্রযোজক, পরিচালকরা পায়ে লুটিয়ে ভিক্ষা চাবে লতার কাছে তাদের ছবিতে একটা গান করার জন্য।
৩. গায়িকা নূর জাহান-এর অনুকরণঃ
কন্ঠশিল্পী নুর জাহান-এর ভক্ত ছিলেন লতা। নিজের সংগীত জীবনের প্রথমদিকে তাঁর অনুকরণ করতেন লতা। কিন্তু ধীরে ধীরে গান গাওয়ার নিজস্ব শৈলী গড়ে তোলেন তিনি।
৪. লতার অভিনয়জীবনঃ
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের মারাঠি নাটক ‘সংগীত নাটক’-এ অভিনয় করেন লতা। তারপর ১৯৪৫-এ মাস্টার বিনায়ক-এর প্রথম হিন্দি ছবি ‘বরি মা’-তে এক ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
৫. ফিল্মফেয়ার-এ সেরা কন্ঠশিল্পীর পুরস্কারের প্রচলন করাঃ
১৯৫৬ সালে লতার গাওয়া ‘রাসিক বালমা’ গানটি ফিল্মফেয়ারে সেরা গান-এর পুরস্কার পায়। লতাকে ফিল্মফেয়ারের অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশন করার জন্য ডাকা হয়। কিন্তু তখনো ফিল্মফেয়ারে গায়ক-গায়িকাদের জন্য আলাদা কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা না থাকার প্রতিবাদে লতা অনুষ্ঠানে গান করতে অস্বীকৃতি জানান। ৩ বছর পর ১৯৫৯ সালে ফিল্মফেয়ারে সেরা গায়কের পুরস্কারের প্রচলন শুরু হয় এবং প্রথম বছরেই তিনি পুরস্কারটি লাভ করেন। তাঁর কিছু বছর পর গায়ক ও গায়িকাদের জন্য পৃথক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়।
৬. লতাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা চেষ্টাঃ
১৯৬২-তে লতা মঙ্গেশকরকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় ১০ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় তাঁকে। বিষক্রিয়া পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে তাঁর আরো ৩ মাস লেগে যায়। কিন্তু এই হত্যা চেষ্টা কে করেছিল তা কখনো জানা যায়নি।
৭. তাঁর গান শুনে কেঁদেছিলেন নেহেরুঃ
১৯৬৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সামনে ভারত-চীনের সীমান্তে চলা যুদ্ধের কিছুকাল পরেই এক অনুষ্ঠানে গান করেন লতা। তাঁর কন্ঠে ‘এ মেরে ওয়াতান কে লোগো” গানটি শুনে কেঁদে দেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু।
৮. সবথেকে বেশি বয়সী জাতীয় পুরস্কার বিজয়ীঃ
১৯৯০ সালে ‘লেকিন’ ছবিতে গান গেয়ে ৬১ বছর বয়সে শ্রেষ্ঠ গায়িকার জাতীয় পুরস্কার জিতে সবথেকে বেশি বয়সে এই সম্মাননা পাওয়ার রেকর্ড করেন লতা।
৯. তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছাঃ
এক সাক্ষাৎকারে লতা তাঁর জীবনের দুইটি অপূর্ণ ইচ্ছার কথা বলেন। প্রথমটি ছিল ভারতীয় গায়ক ও অভিনেতা কে.এল. সায়গল-এর সাথে দেখা করা ও দ্বিতীয়টি ছিল অভিনেতা দিলীপ কুমারের জন্য গান করা। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা দুটি অপূর্ণই রয়ে যায়।
১০. অসংখ্য সম্মাননাঃ
অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় পূর্ণ লতার জীবন। শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে তিনটি জাতীয় পুরস্কার, সাতবার ফিল্মফেয়ার-এর শ্রেষ্ঠ গায়িকার পুরস্কার, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিসহ সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডক্টরেট ডিগ্রি, ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন ইত্যাদি তাঁর পাওয়া অসংখ্য পুরস্কারের মধ্যে কিছুসংখ্যকের নাম।