প্রায় ১৭ বছর ধরে প্রতিপক্ষের অর্ধে রক্ষণভাগকে বোকা বানিয়ে একের পর এক গোল করে নিজেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের তালিকায় নিয়ে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান লেজেন্ডের নাম রোনালদো। ১টি বিশ্বকাপ, ২টি কোপা আমেরিকা, ২বার ব্যালন ডি অর, ৩বার ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার পাওয়া রোনালদো নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সবকিছু অর্জন করেছেন। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও-ের এক গরীব ঘরে জন্মগ্রহণ করে বিশ্বজয় করা এই ফুটবলারের জীবন কোনো রূপকথা থেকে কম নয়।
এই ‘ফেনোমেনন’ ফুটবলারের বর্ণাঢ্য জীবনের ৫টি অজানা তথ্য নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
১. ১৯৯৯ পর্যন্ত ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন ‘রোনালদিনহো’ নামেঃ
১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মত ব্রাজিল দলে সুযোগ পান রোনালদো। কিন্তু তখন দলে রোনালদো রড্রিগেজ ডে জেসুস নামে আরেকজন সিনিয়র ফুটবলার ব্রাজিল দলে ছিল। তাই ১৭ বছরের তরুণ রোনালদোকে ‘রোনালদিনহো’ (পর্তুগীজ ভাষায় যার অর্থ ছোট রোনালদো) নামের জার্সি দেয়া হয়। ৯৪ বিশ্বকাপে মাঠে নামার সুযোগ না পেলেও ১৯৯৬-এর অলিম্পিকসে ব্রাজিলের হয় রোনালদিনহো নামেই খেলেন রোনালদো।
৩ বছর পরে ১৯৯৯ সালে রোনালদো ডি অ্যাসিস মোরেইরা নামের এক নতুন ফুটবলার ব্রাজিল দলে জায়গা পায়। তাকে আমরা এখন সবাই রোনালদিনহো নামে চিনি। তারপর থেকে রোনালদো নিজের নামের জার্সি পরেই ব্রাজিলের হয়ে মাঠে নামেন।
২. সর্বকনিষ্ঠ ব্যালন ডি অর বিজয়ীঃ
১৯৯৬ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সী রোনালদো ১৯ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কাতালান জায়ান্ট বার্সেলোনাতে নাম লেখান ।ক্যাম্প ন্যুতে মাত্র ১ বছর খেলেই সেখানে নিজের ছাপ ফেলে যান তিনি। সেইবছর ক্লাবের হয়ে ৪৯ ম্যাচে ৪৭টি গোল করে বার্সেলোনার স্প্যানিশ কাপ এবং উয়েফা কাপ জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন রোনালদো। তারই পুরস্কারস্বরূপ ১৯৯৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে একইসাথে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার এবং সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ব্যালন ডি অর জয় করেন। তাঁর এই রেকর্ড এখনো অক্ষত আছে।
৩. ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইউনাইটেড সমর্থকদের কাছে পাওয়া অভিবাদনঃ
২০০৩ সালের ২৩শে এপ্রিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ম্যাচে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৪-৩ গোলে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে দেয়। কিন্তু দুই লেগ মিলিয়ে জয়ী হয় রিয়াল এবং টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পরে যায় ইউনাইটেড। আর ম্যানচেস্টারের এই বাদ পড়ার পেছনের মূল হোতা ছিলেন রোনালদো। ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেদিন রোনালদো একাই রিয়াল মাদ্রিদের হয় ৩টি গোল করেন। তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রতিপক্ষ সমর্থকরাও বিমুগ্ধ হয়ে পরে। তাই হ্যাট্রিক পূরণ করার পরে যখন রোনালদোকে বদলি করা হয় তখন ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইউনাইটেড সমর্থকরা তাকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায়। প্রতিপক্ষের মাঠে এরকম অভিবাদন পাওয়া ফুটবল ইতিহাসে খুবই বিরল।
৪. ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর ফিটনেস নিয়ে রহস্যঃ
নানান কারণে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল রহস্যঘেরা। আর এই রহস্যের কেন্দ্রতে রয়েছেন রোনালদো।ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ব্রাজিলের অসহায় আত্মসমর্পণ, ম্যাচের আগে ঘোষিত একাদশে প্রথমে রোনালদোর নাম না রাখা কিন্তু পরবর্তীতে আবার অন্তর্ভুক্ত করা, ফাইনালের দিনে রোনালদোর অসুস্থ হয়ে পরা ও পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও ফাইনালা খেলা এসব কারণে এই ফাইনালটি এখনো ফুটবল সমর্থকদের মাঝে আলোচিত।
ফাইনালের দিন সকালে রোনালদো জ্ঞান হারালে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানের ডাক্তাররা তাকে ফাইনালে খেলার জন্য আনফিট বলে ঘোষণা করে। কিন্তু রোনালদো ব্রাজিলের কোচ মারিও জাগালোকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি খেলার জন্য ফিট। কোচ তার কথায় বিশ্বাস রেখে তাকে মাঠে নামান। সেই সময়ে রোনালদোকে বিশ্বের সেরা ফুটবলার বলে মনে করা হত। স্বভাবতই তার উপর সকলের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ফাইনালে তাঁর প্রদর্শন খুবই বিবর্ণ ছিল। ব্রাজিলও সেদিন তার আগের ক্ষুরধার ফুটবল খেলতে ব্যর্থ হয় এবং ফ্রান্সের কাছে শিরোপা খোয়ায়।
ম্যাচটিকে নিয়ে একাধিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে যে, নাইকি এবং ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের মধ্যে ১০৫ মিলিয়ন ইউরোর ডিলের কারণ আনফিট হওয়া সত্ত্বেও রোনালদোকে জোর করে মাঠে নামানো হয়।
আবার গ্লোবো পত্রিকার মতে ফাইনালের দিন সকালে ব্যাথানাশক ইনজেকশন করটিসোন নান রোনালদো। তারপর ব্রাজিলের আরেক ফুটবলার রবার্তো কার্লোসের সাথে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পরেন তিনি এবং সেই ইনজেকশনের প্রভাবেই তিনি জ্ঞান হারান। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কি সেটা কখনোই জনসম্মুখে আসেনি।
৫. রোনালদোর অতিরিক্ত মেদের পেছনের কারণঃ
ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে রোনালদোর মেদ অনেক বেড়ে যায়। দর্শক, বিশ্লেষক ও সতীর্থদের কাছ থেকে সেজন্য অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হয় তাকে। ২০১১ সালে নিজের অবসরের ঘোষণা দেয়ার পর রোনালদো তার এই অতিরিক্ত ওজনের পেছনের কারণ প্রকাশ করেন।
২০০৭ সালে রোনালদো ‘হাইপোথাইরয়েডিজম‘ রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন ক্ষরিত হয় না। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পরা, বিষন্নতা এবং ওজন বৃদ্ধি পাওয়া এই রোগের কিছু উপসর্গ। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ৪ বছর ধরে হরমোন ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নামতেন রোনালদো। কিন্তু ফিফা সেই ইনজেকশনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে ফুটবল মাঠ থেকে অবসর নিতে হয়।