শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ এক অপরাজেয় কথাশিল্পী

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পী। তাঁর লেখনীতে আমরা চিরাচরিত গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি, দারিদ্র্য ও সামাজিক কুসংস্কারে ক্লিষ্ট সাধারণ মানুষ ও বাংলার মানুষ ও প্রকৃতির সরল সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হই। বাংলার সাধারণ মানুষদের সরল মনকে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই তাঁর কল্পিত চরিত্রগুলোর মাঝে নিজেদেরকে দেখতে পায় পাঠকেরা আর তাঁর রচনাগুলো পায় আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। আর তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’।

১৮৭৬ সালের ১৫-ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে শরৎচন্দ্র এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। ভাগলপুরে মায়ের বাড়িতেই তাঁর বেড়ে উঠা। শরৎচন্দ্র প্রথমে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয় ও পরে ভাগলপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পিতার চাকরি চলে গেলে তাঁর পরিবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসে। সেখানে তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হোন কিন্তু অর্থকষ্টের কারণে তাকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হয়। তারপর শরৎচন্দ্র আবারো ভাগলপুরে ফিরে গিয়ে সেখানে প্রতিবেশী তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে বিদ্যালয়ে ভর্তি হোন এবং সেখান থেকে ১৮৯৪ সালে এন্ট্রাস পরীক্ষা পাস করেন। তারপর একই কলেজে এফ.এ. শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু এফ.এ পরীক্ষার ফি জমা করতে না পারায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন সেখানেই থেমে যায়।

হুগলীতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর বাড়ির বর্তমান অবস্থা।

শরৎচন্দ্রের কর্মজীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। কোনো এক পেশায় তিনি বেশিদিন টিকতে পারেননি। বনেলি রাজ-এস্টেটে সেটেলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। এই সময় পিতার সাথে রাগ করে তিনি সন্ন্যাসী দলে যোগ দেন। পিতার মৃত্যুর পর সন্ন্যাসী জীবন ছেড়ে ভাগলপুরে ফিরে আসেন। তারপর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রেঙ্গুনে বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি পদে চাকরি শুরু করেন। তিন বছরের মাথায় চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে ১৯০৬ সালের এপ্রিলে বার্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসে নতুন চাকরি শুরু করেন। ১০ বছর তিনি সেই অফিসেই চাকরি করেন। কিন্তু ১৯১৬ সালে অফিসে ছুটি নিয়ে মনোমালিন্যের পরে তিনি রেঙ্গুন ছেড়ে আবারো কলকাতায় চলে আসেন।

১৯০৫ সালে রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে বাস করার সময় তাঁর বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বসবাস করতেন। শান্তি দেবীর বাবা তার অমতে এক মদ্যপের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেন।  শান্তি শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করলে শরৎচন্দ্র তাঁকে বিয়ে করে ফেলেন। তাঁদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তাঁর এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। তার অনেক বছর পর শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তাঁর ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন।

শরৎচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। স্কুলের পড়ার সময়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তাঁর পিতার আলমারি থেকে গল্পের বই বের করে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন তিনি। এ সম্পর্কে শরৎচন্দ্র নিজেই বলেছেন-

“এবার বাবার আলমারির ভাঙা দরাজ থেকে খুঁজে বের করলাম ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ আর ‘ভবানী পাঠক’ গুরুজনদের দোষ দিতে পারিনে। স্কুলের পাঠ্য নয়, এগুলো বদ ছেলেদের অপাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাঁই করে নিতে হলো আমাকে গোয়ালঘরে।”

শরৎচন্দ্রের পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যের সব শাখাতেই সৃষ্টির চেষ্টা করলেও তাঁর কোনো রচনা সমাপ্ত করতে পারেননি। শরৎচন্দ্র পিতার অসমাপ্ত উপন্যাস, নাটক, গল্প ও কবিতাগুলো প্রায়ই পড়তেন এবং লেখাগুলো তিনি কিভাবে শেষ করতেন তা নিয়ে ভাবতেন। পিতার অসমাপ্ত গল্প বা উপন্যাসের শেষ ভাগে কী হতে পারে! কল্পনার সূত্র ধরেই শরৎচন্দ্র সেই ছেলেবেলা থেকে গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন-

‘পিতার কাছ থেকে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্য-অনুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি। পিতৃপ্রদত্ত প্রথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল। আমি অল্প বয়সে সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি আর দ্বিতীয় গুণটির ফলে জীবনভর কেবল স্বপ্ন দেখেই গেলাম। আমার পিতার পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ, ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতা এককথায় সাহিত্যের সব বিভাগে তিনি হাত দিয়েছিলেন কিন্তু কোনোটাই তিনি শেষ করতে পারেননি। তার লেখাগুলো আজ আমার কাছে নেই, কবে কেমন করে হারিয়ে ফেলেছি সেই কথা আজ মনে পড়ে না। কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে ছোটবেলায় কতবার তার অসমাপ্ত লেখাগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি- এগুলো শেষ করে যাননি বলেও কত দুঃখ না করেছি। তার লেখার অসমাপ্ত অংশগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্ররজনী কেটেছে। তবে এ কারণেই বোধহয় আমি ১৭ বছর বয়সে লেখা শুরু করি।’

তাঁর প্রথম উপন্যাস বড়দিদি  ভারতী পত্রিকায় ১৩১৪ বঙ্গাব্দে ৩ খন্ডে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি জনপ্রিয় হয় এবং তাঁর লেখাকে রবীন্দ্রনাথের লেখার সাথে তুলনা করা হয়। ১৯১৩ সালে উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি একে একে বিরাজবৌ (১৯১৪), পন্ডিতমশাই (১৯১৪), পল্লী-সমাজ (১৯১৬), চন্দ্রনাথ( ১৯১৬), শ্রীকান্ত-প্রথম পর্ব (১৯১৭),  দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), দত্তা (১৯১৮), শ্রীকান্ত-দ্বিতীয় পর্ব (১৯১৮) ইত্যাদি উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর রচিত সর্বশেষ উপন্যাস শুভদা (১৯৩৮)। তরুণের বিদ্রোহ, (১৯১৯),স্বদেশ ও সাহিত্য, (১৯৩২) তাঁর রচিত দুটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ। রামের সুমতি (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪),পথ-নির্দেশ (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৫), বৈকুণ্ঠের উইল (১৯১৬), অরক্ষণীয়া (১৯১৬), নিষ্কৃতি (১৯১৭) তাঁর রচিত অন্যতম গল্পগ্রন্থ।

এগুলির মধ্যে ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’ ‘গৃহদাহ’, ‘দেনা-পাওনা’ এবং ‘পথের দাবী‘ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু তাঁর ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি বিপ্লববাদের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। 

তাঁর উপন্যাসের মূল উপজীব্য ছিল পল্লী জীবন। পল্লীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা ব্যক্তি জীবনকে কতটা দুর্বিষহ করে দিতে পারে তাই শরৎচন্দ্র তাঁর লেখনী দ্বারা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। নারীর প্রতি চলে আসা সামাজিক নির্যাতন এবং নারীকে দমিয়ে রাখার জন্য তৈরিকৃত কুসংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন শরৎচন্দ্র। সমাজের নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতি এবং উঁচু শ্রেণীতে আসীন ব্যক্তিবর্গের প্রতি অবজ্ঞা তাঁর লেখনীর এক নিয়মিত অনুষঙ্গ।

প্রাঞ্জল লেখনী, রচনায় সাবলীল ভাষা তাঁর সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর সাহিত্য সহজেই মানুষের বোধগম্য ছিল বিধায় বাংলার সকল শ্রেণীর সাহিত্য প্রেমিকদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অসম্ভব জনপ্রিয়।

সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যপদ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন

১৯৩৭ সালে শরৎচন্দ্রের যকৃতে ক্যানসার ধরা পরে। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার করা হয় এবং তার চার দিন পরেই কলকাতার পার্ক নার্সিং হোমে তিনি দেহত্যাগ করেন। 

 শরৎচন্দ্র যখন লেখা শুরু করেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের সমপর্যায়ের সাহিত্য রচনা করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্য জগতে তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন নিজস্ব এক পরিচয়। গত শতাব্দীর সাহিত্যিক হলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম এখনো সমান জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক। দারিদ্র্যকে জয় করে এসে বাংলা উপন্যাসকে নবজীবন দেয়া এই সাহিত্যিক চিরকাল বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বলে গণ্য হবেন।

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *