নাগিন নাচের ইতিকথা

বর্তমানে এশিয়ায় ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পাশাপাশি এক নতুন দ্বৈরথ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার মধ্যে। বিগত কয়েকবছর ধরে এই দুই দলের মধ্যে চলে আসছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কিন্তু ২০১৮-এর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফিতে এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ক্রিকেট প্রতিযোগিতা পায় নতুন মাত্রা। আর ভাবতে অবাক লাগলেও বাংলাদেশ শ্রীলংকার মধ্যে এই দৈরথের পেছনের অন্যতম অনুঘটক হচ্ছে ‘নাগিন নাচ’। বাংলাদেশের স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপুর উইকেট নেয়ার পরে কোবরার অনুকরণ করে করা উদযাপন কিছু সময়ের জন্য হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট বিশ্বের সব থেকে আলোচিত বিষয়। কিন্তু এই নাগিন নাচ শুরু হল কোথা থেকে?

কাহিনীর সুত্রপাত হয়ে ২০১৬ সালের বি.পি.এল থেকে। সেবার রাজশাহী কিংসের অধিনায়ক ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ-এর সাবেক অধিনায়ক ড্যারেন সামি। সেবছর একই দলে সুযোগ পেয়েছিলেন অপু। সামি অপুকে ডাকনাম দিয়েছিলেন ‘snake’ (সাপ), কারণ সামির কাছে অপুকে দেখতে নাকি অনেকটা সাপের মত মনে হত। অদ্ভুত এই ডাকনাম অপুর পছন্দ হয়ে যায়। সেই বছর থেকেই উইকেট পাওয়ার পর নাগিন নাচ করা শুরু করেন অপু।

“বিপিএল-এ২০১৬ সালে রাজশাহী কিংসের হয়ে খেলার সময় টিমের ক্যাপ্টেন ছিল ড্যারেন স্যামি। ওকে ভয় দেখানোর জন্য নাগিন নাচ দেখাতাম। মজার ব্যাপার হল, ও ভয়ও পেত, মজাও পেত! ওখান থেকেই শুরু ব্যাপারটা। একটা ম্যাচে উইকেট নেয়ার পর আমি ওই নাচ নাচি। সেখান থেকেই শুরু।”

নাজমুল ইসলাম অপু

প্রায় ২ বছর বিপিএল-এ এভাবেই উইকেট শিকার উদযাপন করতে থাকেন অপু। কিন্তু ২০১৮তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পরে তার এই উদযাপন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখে পড়ে।

বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ১০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে, শ্রীলংকার বাংলাদেশ সফরের কিছুদিন পূর্বেই বাংলাদেশের কোচের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজ দেশের জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন। তারপর শ্রীলংকার হয়ে নিজের সদ্য সাবেক শিষ্যদের বিপক্ষে সিরিজে বাংলাদেশ দল এবং খেলোয়াড়দের সম্পর্কে তার জ্ঞান ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রণ কৌশল সাজান। ঘরের মাটিতে বাংলাদেশ প্রথমে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ট্রাই সিরিজে পরাজিত হয়, তারপর টি-টুয়েন্টি ও টেস্টেও বাংলাদেশ শ্রীলংকার হাতে নাস্তানাবুদ হয়। সেই সিরিজের ২য় ও শেষ টি-টুয়েন্টি ম্যাচের ১ম ইনিংসে শ্রীলংকার ব্যাটসম্যান গুনাতিলাকাকে আউট করে ‘নাগিন নাচ’ দিয়ে উদযাপন করেন অপু। ২য় ইনিংসে গুনাতিলাকা একটি উইকেট পাওয়ার পরে অপুকে ব্যঙ্গ করে অঙ্গভঙ্গি করেন।

তারপর আবার মার্চ মাসে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত হয় ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার মাঝে নিদাহাস সিরিজ। গ্রুপ পর্যায়ে বাংলাদেশ শ্রীলংকার মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক ম্যাচ চলছিল। ঘরের মাঠে সাবেক গুরুর নতুন শিষ্যদের কাছে লজ্জাজনক পরাজয়ের পরে বাংলাদেশ দল জয়ের জন্য মরিয়া ছিল। শ্রীলংকা প্রথমে ব্যাট করে ২১৪ রানের বিশাল স্কোর দাঁড় করায়। জবাবে তামিম ও লিটনের ওপেনিং জুটির ঝড়ো শুরুর পর শেষের মুশফিকের ৩৫ বলে ৭২ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে চড়ে বাংলাদেশ শ্রীলংকার রানের পাহাড় টপকে যায়। কিন্তু মুশফিকের ব্যাটিং নৈপুণ্য থেকে ম্যাচ জয়ের পর তার উদযাপন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

ঘরের মাঠে করা গুনাতিলাকার ব্যাঙ্গ বোধ হয় মনে রেখেছিলেন মুশফিক। তাই ম্যাচ জয়ের সাথে সাথে ‘নাগিন নাচ’ করে জয় উদযাপন করেন।

সাথে সাথে বিশ্বমিডিয়ার নজরে চলে আসে ‘নাগিন নাচ’। সাবেক প্লেয়ার, সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই এর সমালোচনা করেন, আবার অনেকে একে মজার ছলেই দেখেন।

কমেন্ট্রি বক্সে ফাইনাল ম্যাচে নাগি নাচ করতে দেখা যায় সুনীল গাভাস্কারকে।

গ্রুপ পর্বের ২য় ম্যাচে যখন দল দুইটি আবারো মিলিত হয় তখন ক্রিকেটারদের মধ্যকার উত্তেজনা দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে পরে। জিতলে ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল খেলার সুযোগ এবং হারলে টুর্নামেন্ট থেকে বাদ, এমন সমীকরণে দুই দল যেকোনোভাবে ম্যাচটি জেতার জন্য মাঠে নামে। ম্যাচজুড়ে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে চলতে থাকে স্লেজিং। কিন্তু শেষ ওভারে এসে এই উত্তেজনা এক নতুন মাত্রা পায়।

শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ১২ রান। হাতে মাত্র ৩ উইকেট। স্ট্রাইকে ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। ১ম বল ডট হওয়ার পর ২য় বলে বাই রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে যান মুস্তাফিজুর। কিন্তু তারপরই মাহমুদুল্লাহ আম্পায়ারের সাথে তর্ক করা শুরু করেন। আসলে ওভারের প্রথম দুই বলই কাঁধের উপর বাউন্সার করেন বোলার উদানা। কিন্তু নিয়ম অনুসারে আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ওভারে একবারের বেশি বাউন্সার করা যায় না। তাই ওভারের ২য় বলটি ওয়াইড কেন দেয়া হল না সেটা নিয়ে তর্ক হচ্ছিল ব্যাটসম্যান মাহমুদুলাহ ও আম্পায়ারের মধ্যে। তখন এই বিতন্ডার মাঝে শ্রীলংকার অলরাউন্ডার পেরেরা জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য পানীয় নিয়ে আসা বদলি খেলোয়াড় নুরুল হাসান পেরেরাকে সরতে বললে পেরেরা তাকে সেখান থেকে ঠেলে দূরে সরাতে চান। তখন নুরুল তাকে আঙ্গুল তুলে শাসানো শুরু করেন।

পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে পরে যখন বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব মাঠে নেমে তার ব্যাটসম্যানদের ড্রেসিং রুমে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার হুমকি দেয়। ব্যাটসম্যানদের বাউন্ডারির সীমানা পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে খেলা আবারও শুরু হয়। মাহমুদুল্লাহ পরবর্তী ৩ বলে ৪, ২, ৬ রান নিয়ে ১ বল হাতে রেখেই বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়ে দেন। আর তারপর বাংলাদেশের সব খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ মাঠে নেমে পরে শ্রীলংকার দর্শকদের উদ্দেশ্য করে নাগিন নাচ নাচা শুরু করে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ফাইনালে ভারতকে সমর্থন করার জন্য এবং বাংলাদেশকে দুয়ো দেয়ার জন্য দলে দলে শ্রীলংকান দর্শকরা দলে দলে মাঠে আসে। ফাইনালে জেতার খুব কাছাকাছি যেয়ে শেষ দুই ওভারে দীনেশ কার্তিকের দানবীয় ব্যাটিং-এর কারণে বাংলাদেশ শেষ বলে ম্যাচটি হেরে যায়। গ্যালারির উল্লসিত শ্রীলংকার দর্শকরা তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন।

বাংলাদেশ শ্রীলংকার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রিকেটের জন্য অবশ্যই মঙ্গলকর। কিন্তু এই উত্তেজনা যে মাত্রা ছাড়িয়ে না যায় সেজন্য উভয় দলের খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের সতর্ক হতে হবে।

Post Author: Usamah Ibn Mizan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *