তার বই বিক্রি হয়েছিলো ২০০ কোটি কপির ওপরে, অনূদিত হয়েছে ১০৩টি ভাষায়। বই অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র থিয়েটারে চলেছে ষাট বছরেরও অধিক সময় ধরে। সমালোচকরা বলতেন, শৈল্পিক গুণে মানে শেক্সপিয়ারের পরেই তার স্থান। সারা পৃথিবীতে “দ্যা কুইন অফ মিস্টেেরি” নামে পরিচিত তিনি।
হ্যা, বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির কথাই বলছি। গোয়েন্দা উপন্যাস আর অপরাধ কাহিনী লিখে এত জনপ্রিয়তা তার আগে আর কোন লেখক পাননি। সাহিত্য জগতের অসাধারণ সৃষ্টিশীল, জনপ্রিয়, সার্থক ও খ্যাতিমান এই ব্যক্তিত্বকে নিয়েই আজকের লেখা।
প্রথম জীবনে আগাথা
১৮৯০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের টর্কির অ্যাশফিল্ড ম্যানশনে এক ধনাঢ্য পরিবারে আগাথার জন্ম। মা ক্ল্যারা বোহমার ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত, বাবা ফ্রেডরিক বোহমার জন্মসূত্রে আমেরিকান; যিনি একজন সফল স্টক ব্রোকার ছিলেন।
গৃহশিক্ষকের কাছে আগাথা লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। ইংরেজি ও অঙ্কের সাথে সাথে টুকটাক সঙ্গীতও শেখেন। ইংরেজির মতো ফ্রেঞ্চ বলতেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। এর রহস্য উন্মোচনে তিনি বলেন,
“আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, আমরা সপরিবারে তখন বেশ কিছুদিনের জন্য ফ্রান্সে চলে যাই। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকি আমরা। আমার জন্য রাখা হয় একজন ফ্রেঞ্চ পরিচারিকা, তার নাম ছিল মেরি। ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই।”
মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মালেও আগাথার সে সুখ বেশি দিন টেকেনি। ১৯০১ সালে তার বাবা মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখন তার বয়স মাত্র ১১। মা ও বোনসহ আগাথা পড়েন অকূল পাথারে।
পুরো পরিবার যখন সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে, তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন আগাথার মা। সময়টা ১৯১০ সাল। এ অবস্থায় আবহাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে পুরো পরিবার, অর্থাৎ মা ও দুই মেয়ে মিসরের রাজধানী কায়রোতে চলে যান এবং তিন মাস কায়রোর ‘গেরিজা প্যালেস হোটেল’-এ অবকাশ যাপন করেন।
কায়রো থেকে ফিরে এসে তিনি মন দেন লেখালেখিতে। প্রথম দিকে সফলতার চেয়ে তার ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি হলেও আগাথা হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
এর মাঝে আগাথার জীবনে প্রথমবারের মতো আসে ভালোবাসা। ১৯১৪ সালে তিনি বিয়ে করেন আর্চিবল্ড ক্রিস্টিকে। তিনি ছিলেন ‘রয়েল ফ্লায়িং কোর’-এর এক পাইলট। আগাথা ক্রিস্টির একমাত্র মেয়েসন্তান রোজালিন্ড হিক্সের জন্ম হয়েছিল তার প্রথম স্বামী আর্চিবল্ড ক্রিস্টির ঔরসে।
আগাথার বিয়ের কিছুদিন পরই বেজে ওঠে প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা। মিত্রশক্তির হয়ে লড়তে আর্চিবল্ড উড়াল দেন ফ্রান্সে । এ দিকে আগাথা ক্রিস্টিও স্বদেশের মাটিতে থেকে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সম্মুখ সমরে নার্স ও ফার্মাসিস্ট হিসেবে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সেবা করেন তিনি।
আর্চিবল্ড-আগাথার বিবাহিত জীবন বেশি দিন টেকেনি। বিয়ের তেরো বছরের মাথায় ১৯২৮ সালে আর্চিবল্ডের পরকীয়ার কথা জেনে ফেলার পর তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু স্বামীর পদবি ত্যাগ করেননি তিনি। কারণ আগাথার লেখালেখির পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলেন আর্চিবল্ড।
১৯৩০ সালে মেসোপটেমিয়ার ‘ঊর’ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য পরিদর্শন করতে যান তিনি। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় ম্যাক্স ম্যালোওয়ান নামে এক তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদের। একপর্যায়ে পরিচয় রুপ নেয় ভালোবাসায়। ম্যালোয়ানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এ নিয়ে আগাথা মজা করে বলেছিলেন,
“প্রত্নতত্ত্ববিদেরা স্বামী হিসেবে সবচেয়ে ভালো। যতই বুড়ো হবেন, আপনার প্রতি তার আগ্রহ তত বাড়বে!”
লেখিকা আগাথা: কর্ম ও মূল্যায়ন
অপরাধ জগতে অবিসংবাদিত এই রানি লিখে গেছেন ৬৬টি গোয়েন্দা উপন্যাস, ১৪টি ছোটগল্প সঙ্কলন, একটি কাব্যগ্রন্থ, ১৬টি নাটক ও একটি সম্পাদিত বই। এ ছাড়াও মেরি ওয়েস্টম্যাকট ছদ্মনামে তিনি রচনা করেছেন আরো ছয়টি রোমান্টিক উপন্যাস, দু’টি করে কবিতা ও আত্মজীবনীমূলক বই।
তার প্রথম উপন্যাস রচনার পেছনের গল্পটাও বেশ আকর্ষণীয়। বোনের ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জের জবাবে কলম ধরেন তিনি। লিখে ফেললেন প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস “The Mysterious Affair at Styles”। পরপর দুজন প্রকাশকের প্রত্যাখানের পর, তৃতীয় জনের অনুগ্রহে ১৯২০ সালে ছাপা হয় এটি। কিন্তু বাজারে খুব একটা কাটতি পায়নি।
ঊর’ ভ্রমণ থেকে আগাথা ক্রিস্টি পেয়েছিলেন “Murder in Mesopotamia” এবং” Death on the Nile” উপন্যাসগুলোর কাহিনী। এরপর তিনি সিরিয়া সফর করেন এবং সিরিয়া অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন “Come, Tell Me How You Live “। তারপর আগাথা যান তুরস্ক। ইস্তাম্বুলের ‘প্যারা প্যালেস’ হোটেলের কক্ষেই রচিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস “Murder on the Orient Express”।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নার্সের কাজ করার সময় তার পরিচয় হয় এক বেলজিয়ান শরণার্থীর সাথে, যে একসময়ে বিখ্যাত পুলিশ অফিসার ছিল। তার থেকে আগাথা “এরকুল পোয়ারো” চরিত্রটির ধারণা পান। আর “মিস মার্পল” চরিত্রটি সৃষ্টির পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলেন তার বড় পিসি। আগাথা ক্রিস্টির সৃষ্ট বিপরীতধর্মী এই দু’টি চরিত্র জনপ্রিয়তায় সব যুগের সব রেকর্ড ভাঙতে সফল হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আগাথা ক্রিস্টি লন্ডন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের বিষের সাথে পরিচিত হন। পরবর্তী জীবনে গোয়েন্দা উপন্যাস লিখতে গিয়ে এ বিদ্যা সফলতার সাথে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি।
কেবল বইয়ের সংখ্যা দিয়ে আগাথা ক্রিস্টির কৃতিত্ব বিচার করা অসম্ভব। এ পর্যন্ত আগাথা ক্রিস্টির বই বিক্রি হয়েছে ২০০ কোটি কপির ওপরে। কোনো কোনো জরিপ অনুযায়ী, কাটতির হিসেবে বাইবেল ও শেক্সপিয়ারের বইয়ের পরই আগাথা ক্রিস্টির স্থান। তার বিভিন্ন বই ১০৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেননি।
তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘দি মাউসট্র্যাপ’ নাটক লন্ডনের “West End Theatre” -এ ১৯৫২ সালে থেকে বিরতিহীনভাবে মঞ্চস্থ হয়ে আসছে। এপর্যন্ত নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে ২৭ হাজার বারেরও বেশি। শেক্সপিয়ার বাদে বিশ্বের অন্য কোনো নাট্যকারের নাটক, দর্শকেরা এভাবে পাগল হয়ে দেখেছে বলে জানা নেই।
আগাথা ক্রিস্টির গল্পের অনুপ্রেরণায় বাংলা ভাষায় এবং ভারতীয় সিনেমা জগতে বেশ কিছু চলচিত্র নির্মিত হয়েছে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবি হলো চুপি চুপি আসে, শুভ মহরৎ। হিন্দিতে ‘গুমনাম’, ধন্ধ ইত্যাদি।
ব্যক্তিজীবনে আগাথা
ছোটবেলা থেকে একজন বইপাগল মানুষ হিসেবেই গড়ে উঠেছিলেন তিনি। হাতের কাছে যা পেতেন তাই পড়তেন। হ্যাট-টুপি ছিল তাঁর প্রিয় শখের মধ্যে একটি। বিভিন্ন ধরণের হ্যাট পরতে পছন্দ করতেন আগাথা। পিয়ানো ও ম্যান্ডেলিন বাজাতে জুড়ি ছিলোনা তার।
শোনা যায়, আগাথা নিজে হাতে গল্প লিখতেই বেশি পছন্দ করতেন। অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে তাঁর মাথায় গল্পের প্লট আসত। যেমন কখনো হয়তো সেটা হ্যাট-টুপির দোকানে কিম্বা রাস্তায় যখন তিনি একা হাঁটছেন তখন।
এই রহস্য সাহিত্যিকের জীবনটাও ছিলো বেশ রহস্যমন্ডিত। ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগত রাখতেই ভালোবাসতেন তিনি। একবার ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান আগাথা। প্রায় চারটি দেশের আইন সংস্থা তল্লাশি করেও তাঁর সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয়। প্রায় ১১ দিন পর তাঁকে পাওয়া যায় ইয়র্কশায়ারের এক হোটেলে।
এই ঘটনা নিয়ে নানান গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেন, মহাজাগতিক জীবরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। আবার কারো মতে এটি ছিল নিছক পাবলিসিটি স্টান্ট। আশ্চর্য ব্যাপার হলো ল যে এই বিষয় নিয়ে আগাথা নিজে কোনোদিনই মুখ খোলেননি।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
১৯৭১ থেকে আগাথা ক্রিস্টির শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করে। তিনি বুঝে ফেলেন পারেন তার হাতে আর বেশি সময় নেই। রুগ্ন শরীর নিয়েই সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন। কারো কারো মতে, সেসময় তিনি আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়ায় ভুগছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি ৮৫ বছর বয়সে ইংল্যান্ড মারা যান এই প্রতিভাবান লেখিকা।
এই কীর্তিমান পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন নীরবে-নিস্তব্ধে, অত্যন্ত সাদামাটাভাবে। তার শব শোভাযাত্রায় লাখ-কোটি ভক্ত ও অনুরাগীর কেউই ছিলেন না। হাতেগোনা জনা কুড়ি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে তার কফিন কবরস্থ করা হয়। কেনো এমন অনাড়ম্বর শেষ বিদায় বেছে নিয়েছিলেন তিনি, সেটাও কিন্তু একটা রহস্য!
তথ্যসূত্র:
- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Agatha_Christie
- www.britannica.com/biography/Agatha-Christie