আয়ুশমান খোরানা: বলিউডের এক ‘মধ্যবিত্ত’ পোস্টার বয়ের গল্প

শিক্ষাজীবনটা মোটেও সাদামাটা ছিলোনা তার। সেইসাথে কর্মজীবনটাও। করেছেন রেডিও জকি, ভিডিও জকি এবং টেলিভিশন উপস্থাপকের কাজ। ছিলেন রিয়েলিটি শো’র চ্যাম্পিয়নও। এরপর চলে এলেন বলিউডে। ব্যাতিক্রমী নানা চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে।

বলছি ভিকি অরোরার কথা। কি, চিনতে পারছেন না? হ্যাঁ, ২০১২ সালে বক্স অফিস কাঁপানো ভিকি ডোনার চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে অভিনয় করা আয়ুশমান খোরানার গল্প বলছি। এই ভার্সেটাইল অভিনয়শিল্পীর জীবনের নানা উত্থান-পতনের কথা বলবো অাজ।

বেড়ে উঠলেন যেভাবে

১৯৮৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে ভারতের চন্ডীগড়ে পি. খোরানার এবং পুনাম খোরানার ঘরে আয়ুশমানের জন্ম। বাবা ছিলেন রাজনীতিবিদ, সেইসাথে খন্ডকালীন জ্যোতিষীও। মা ছিলেন গৃহিনী। মায়ের দিক থেকে তিনি বর্মিজ রক্তের অধিকারী।

তার পড়াশোনার সূচনা চন্ডীগড়ের সেন্ট জন’স হাইস্কুল এবং ডিএভি কলেজে। এরপর পান্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ব্যাচেলর এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

অভিনয় জগতে পদার্পণ

আয়ুশমানের অভিনয়জীবনের সূচনা মঞ্চ নাটক থেকে। ডিএভি কলেজের খ্যাতনামা নাট্যগোষ্ঠী “আঘাজ” এবং “মঞ্চতন্ত্র” এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। এই দুটি নাট্যগোষ্ঠীর অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন তিনি। সেইসাথে নানা পুরস্কার জেতেন মুড ইণ্ডিয়া এবং ওয়েসিস এর মতো ফেস্টিভ্যালে।

তার টেলিভিশনে অভিষেক ২০০২ সালে, ভি চ্যানেলে প্রচারিত পপস্টারসে, গায়ক হিসেবে। তবে তাকে খ্যাতি এনে দেয় রিয়েলিটি শো “এমটিভি রোডিজ”। ২০০৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে শো’টির চ্যাম্পিয়ন বনে যান তিনি।

সাংবাদিকতায় পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন শেষে দিল্লীর বিগ এফএমে রেডিও জকির কাজ করেন অনেকদিন। এরপর এমটিভিতে শুরু করেন ভিডিও জকির কাজ।

দারুণ প্রত্যুপন্নমতিতার কারণে জনপ্রিয়তা পেতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি তার। সেট ম্যাক্সে আইপিএল এর ‘এক্সট্রা ইনিংস’ উপস্থাপনা করার প্রস্তাব পান তিনি, লুফেও নেন সেটি। উপস্থাপক ছিলেন স্টার প্লাসের জাস্ট ড্যান্স রিয়েলিটি শো’তেও।

উপস্থাপক হিসেবে প্রশংসাও কুড়িয়েও তর সইছিলোনা তার। ছোটবেলা থেকেই যে তিনি দেখে এসেছেন বলিউডের নায়ক হওয়ার স্বপ্ন! কিন্তু টেলিভিশন থেকে বড় পর্দায় গিয়ে সফল হওয়ার নজীর মিডিয়া জগতে নেই বললেই চলে।

কিন্তু আয়ুশমান হাল ছাড়ার পাত্র নন। নিন্দুকদের মুখে চুনকালি দিয়ে ২০১২ সালে ‘ভিকি ডোনার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলিউডে তার অভিষেক ঘটে। চলচ্চিত্রটিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন যামিনী গৌতম। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক ছিলেন বলিউড সুপারস্টার জন আব্রাহাম।

চলচ্চিত্রটিতে একজন পেশাদার শুক্রাণুদাতার চরিত্রে অভিনয় করে গৎবাধা বলিউড চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা ভেঙ্গে ফেলেন তিনি। বক্স অফিস মাত করার পাশাপাশি তার অনবদ্য অভিনয় সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ে। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রটির ‘পানি দা রাং’ গানটিতে কন্ঠ দেন, যেটি হিট হয়। চলচ্চিত্রটির জন্য সেরা নবাগত অভিনেতা এবং সেরা গায়ক হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতেন তিনি।

এরপর তিনি অভিনয় করেন রোহান শিপ্পির “নটাঙ্কি শালা” চলচ্চিত্রে, যা বলিউডে ভালো ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে অায়ুষ্মান অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র “বেওকুফিয়া” বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।

এরপর একই প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় মুক্তি পায় ‘দম লাগাকে হেইশা’। বক্স অফিস মাত করার পাশাপাশি সেরা হিন্দি ছবি সহ একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয় চলচ্চিত্রটি। প্রশংসিত হয় তার অভিনয় দক্ষতাও।

২০১৭ সালে অক্ষয়ের ‘মেরি পেয়ারী বিন্দু’ তে পরিনীতি চোপড়ার বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি, কিন্তু তা ফ্লপ হয়৷ বছরের শেষদিকে এসে মুক্তি পায় ‘বেরেলি কি বারফি’ ও ‘শুভ মঙ্গলম সাবধান’। যা বাণিজ্যিক ভাবে সফলতার পাশাপাশি সমালোচকদের কাছেও প্রশংসিত হয়।

২০১৮ আয়ুশমানের অভিনয়জীবনের জন্য মাইলফলক বছর হয়ে থাকবে। ‘আন্ধাধুন’ ও ‘বাধাই হো’ ছবিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের দুটি চরিত্রে অভিনয় করে একইসাথে দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করে নেন।  ‘আন্ধাধুন’-এক অন্ধ পিয়ানোবাদকের চরিত্রে অভিনয় করে পরের বছর তিনি জিতে নেন ফিল্মফেয়ার ও ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে সেরা অভিনেতার সম্মাননা। 

চলতি বছরে মুক্তি পেয়েছে আয়ুশমানের সর্বশেষ ছবি ‘ড্রিম গার্ল’। এবার আয়ুশমান টেলিফোনে মেয়েদের কন্ঠসবর নকল করে এক কল সেন্টারে কাজ করে এমন এক ছেলের চরিত্রে অভিনয় করে আরো একবার ব্যতিক্রমী ছবিতে অভিনয় করার নিজের ট্রেন্ডকে ধরে রাখেন। আয়ুশমানের এই ছবিটিও যে ইতিমধ্যেই দর্শকনন্দিত  হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন

আয়ুশমানরা দুই ভাই। তার ছোট ভাই অপারশক্তি খোরানা ‘ওয়ে 104.8’ এফএম রেডিওতে জকি হিসেবে কাজ করছেন।

এছাড়া ২০১১ সালে তিনি তার বাল্যকালের বন্ধু তাহিরা কাশ্যপের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাহিরা পেশায় একজন লেখিকা। তাদের সংসারে রয়েছে একটি পুত্র ও কন্যা সন্তান। তার প্রথম সন্তান বিরাজভীর ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি জন্ম নেয়। ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল জন্ম নেয় কন্যা সন্তান ভারুষ্কা।

নিজের চলচ্চিত্র ‘মেরি প্যায়ারি বিন্দু’র প্রচারে আয়ুশমান জানান একসময় ট্রেনে গান গেয়ে রোজগার করতেন তিনি। গান শুনে খুশি হয়ে ট্রেনের যাত্রীরা তাকে যে টাকা দিতো তা পড়াশুনার কাজে ব্যয় করতেন।

আয়ুশমান বলেন,

“পশ্চিম এক্সপ্রেসে চড়ে দিল্লি থেকে মুম্বাই চলে যেতাম। আর কামরায় কামরায় ঘুরে ঘুরে গান গাইতাম। যাত্রীরা আমার গান শুনে খুশি হয়ে টাকাপয়সাও দিতেন। এভাবে গান গেয়ে টাকাপয়সা জমিয়ে এক বার গোয়াতে ছুটি কাটাতেও গিয়েছিলাম!”

আয়ুশমান খোরানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বেশ পছন্দ করেন। সুযোগ পেলেই তিনি নাকি দাঁত মাজেন। টুথপেস্ট আর টুথব্রাশ হাতে আয়ুশমান, এই ছবি বহুবার দেখেছেন তাঁর ভক্তরা।

***

মঞ্চ নাটক, রেডিও, টেলিভিশন অত:পর চলচ্চিত্র সব মাধ্যমেই আলো ছড়িয়েছেন এই প্রতিভাবান শিল্পী। একসময়কার বলিউডের গৎবাঁধা নাচ-গান আর অ্যাকশনের গণ্ডি ভেঙে যারা এক নতুন জগত নির্মাণ করে চলেছেন, আয়ুশমান তাদেরই একজন। তার চলচ্চিত্রে নিহিত থাকে বিভিন্ন সামাজিক বার্তা, যা শুধু দর্শকদের অানন্দই দেয় না, ভাবতেও শেখায়।

গায়ক থেকে উপস্থাপক, উপস্থাপক থেকে নায়ক হয়ে ওঠা এই কুশলী শিল্পী সবে পা দিয়েছেন চৌত্রিশে। ক্যারিয়ারে পড়ে অাছে অারো অনেক সময়। আয়ুশমানের হাত ধরে এগিয়ে চলুক বলিউড, এটিই প্রতাশ্যা শুভানুধ্যায়ীদের।

Post Author: Usamah Ibn Mizan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *