এক
নিদা রহিম।
একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মিলিটারি ট্রেইনি অফিসার। সামরিক অ্যাকাডেমিতে অধ্যয়নের ফলে সামরিক শাসনই তার ধ্যান-জ্ঞান। আইনের বহির্ভূত যেকোন কর্মকাণ্ডই তাঁর দৃষ্টিতে অপরাধ।
কাজের প্রতি অনুরক্ত নিদা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও দেশকে জঙ্গিমুক্ত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। নিদার বিশ্বাস, নির্দোষ মানুষ মেরে যারা নিজের স্বার্থ হাসিল করে, তারা কখনো প্রকৃত মুসলিম হতে পারে না।
নিদার কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে ট্রেনিং শেষ হবার পাঁচ সপ্তাহ আগেই তাকে মেঘদূত ৩১ এ নিয়োগ দেওয়া হয়, যেখানে জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুই
শাহনেওয়াজ রহিম।
নিদা করিমের পিতা। সেইসাথে একজন শিক্ষক, যিনি তার ছাত্রদের মৌলিক অধিকারের পক্ষে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেন৷ নিজের মনোভাবে তিনি অনেকটা একরোখা, অটল ও অনমনীয়৷
নিদার দৃষ্টিতে তার বাবা একজন রাষ্ট্রদ্রোহী৷ জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত সন্দেহে নিদা তাকে তুলে দেয় অাইনের হাতে৷ এর পর থেকেই নিখোঁজ শাহনেওয়াজ রহিম৷
তিন
আলী সাইয়েদ৷
ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলার প্রধান সন্দেহভাজন অাসামী। অনেক তল্লাশী-অভিযান চালিয়েও গ্রেফতার করা যায়নি তাকে৷ কিন্তু একদিন হঠাৎ স্বেচ্ছায় এসে ধরা দেয় সে৷ তাকে প্রেরণ করা হয় যাওয়া হয় কনডেম সেল মেঘদূত ৩১ – এ।
নতুন ক্যাম্পে পৌঁছে নিদা জানতে পারে অালী সাঈদকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডেকে আনা হয়েছে তাকে। নিদা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তখন থেকে ঘটতে শুরু করে অঘটন। খবর অাসে আবু সাঈদের বাসায় তার নিজের লাশ পাওয়া গেছে। ডিএনএ টেস্ট করে প্রমাণও মিলেছে।
তাহলে নিদা যে আবু সাঈদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, সে অাসলে কে? অনেক বছর লুকিয়ে থাকার পর কেনইবা স্বেচ্ছায় ধরা দিলো? নিদার বাবা হঠাৎ করে কেন নিখোঁজ হলো? এই সকল প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে যেতে হবে একটু পেছনে।
***
ভারত।
তবে এই ভারত বর্তমান সময়ের ভারত নয়। এই ভারত সূদূর ভবিষ্যতের এক ডিসটোপিয়ান ভারত, যেখানে চলছে একচ্ছত্র সামরিক শাসন৷ পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে একনায়কতন্ত্রের বিষবাষ্প৷ মুক্তচিন্তার চর্চা এ দেশের অপরাধের শামিল, রাষ্ট্র যা নির্ধারণ করে দেবে সেটিই বিনাবাক্য শিরোধার্য।
মুক্তবুদ্ধি ও বাকস্বাধীনতার চর্চাকে রুখে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে কনডেম সেল, ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই তুলে নেয়া হচ্ছে যে কাউকে, দিনের পর দিন জিজ্ঞাসাবাদের নামে করা হচ্ছে অবর্ণনীয় নির্যাতন৷
ফলে জনমনে ছড়িয়ে পড়ছে অসন্তোষ, ক্ষোভ ও ঘৃণা, যা জমতে জমতে রূপ নিয়েছে সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদে। প্রতিদিনই শহরের অানাচে কানাচে ফাটছে বোমা, নির্বিচারে মরছে নিরীহ মানুষ। ঠিক এমনই এক গুমোট পরিবেশের মধ্য দিয়ে Ghoul সিরিজটির সূচনা।
হ্যাঁ, পাঠক ২৪ অাগস্ট নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া হরর সিরিজটির কথাই বলছি। স্যাকরেড গেমস এর পর Ghoul এখন নেটফ্লিক্স জগতে ‘দ্যা নেক্সট বিগ থিং’।
ঘউল কি?
ইসলামিক মিথোলজী অনুসারে Ghoul হলো একধরণের প্রাচীন অশরীরী, যারা বাস করে নির্জন মরুভূমি বা কবরস্থানের আশপাশে। এই রক্ত-মাংস খেকো পিশাচ কবরের লাশ খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। সর্বশেষ যার শরীরের মাংস খায় তার শরীরের রূপ ধারণ করে বেঁচে থাকে এবং উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়না৷
কেউ যদি একটি বিশেষ চিহ্ন একেঁ নিজের শরীরের রক্ত Ghoul এর প্রতি উৎসর্গ করে, তবে Ghoul তাকে সাহায্য করতে অাবির্ভূত হয়৷ অার এসব কিছুর গুরু হচ্ছে লুসিফার বা শয়তান, যে Ghoul দের পরিচালনা করে মানুষের মধ্যে কুমন্ত্রণা আর প্রতিহিংসা ঢুকিয়ে দেয়। যার ফলে মানুষও একে অপরকে খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনা।
নির্মানের অাদ্যোপান্ত:
নেটফ্লিক্সের অরিজিনাল সিরিজ Ghoul মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হরর৷ অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে Ghoul সিরিজের প্লটটি স্বপ্নে পাওয়া৷ সিরিজটির পরিচালক পেট্রিক গ্রাহাম ‘এক আগন্তক বন্দির ভয়ে কারাগারের রক্ষীসহ সবাই ভীত’- এরকম একটি স্বপ্ন দেখেন৷ ঘুম থেকে ওঠার পরই স্বপ্নটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে স্ক্রিপ্ট আকারে লিখে ফেলেন তিনি।
প্রথমে Ghoul নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন গ্রাহাম। কিন্তু এর প্লট জানতে পেরে নেটফ্লিক্স সিরিজটির সাথে যুক্ত হয়। এভাবেই নির্মিত হয় তিন এপিসোডের একটি মিনি সিরিজ। যার পরবর্তী সিজন খুব শিগগিরই অাসবে বলে সম্ভাবনা রয়েছে।
Ghoul সিরিজের প্রায় ৯০ ভাগ দৃশ্যের চিত্রায়ন করা হয়েছে মেঘধূত নামক একটি টর্চার সেলে৷ ইরাকের আবু গারিব কারাগারের আদলে নির্মিত এ বন্দীশালায় ফুটে উঠেছে কীভাবে বন্দীদের নির্যাতন করা হয়৷ এছাড়াও কাশ্মীরে অবস্থিত ‘ক্যাম্প এক্স- রে’ এ বন্দী নির্যাতনের ভয়াবহ সব পদ্ধতি অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে সিরিজটিতে।
অল্পকিছু দৃশ্য বাদে পুরো সিরিজটিই ধারণ করা হয়েছে অালো-অাধারির মাঝে। যার ফলে সিরিজজুড়েই দর্শকরা পরিচিত হবেন একটা থমথমে পরিবেশের সাথে। সেই সাথে নেপথ্যে বাজতে থাকা মিহি সংগীত যে কারো গায়ের পশম দাড়া করাতে বাধ্য ! অার সিরিজটির স্ক্রিনপ্লে অত্যন্ত গতিশীল হওয়ার কারণে দর্শকরা চোখ সরানোর সুযোগ খুব কমই পাবেন।
অভিনয়:
এই সিরিজের মূল চরিত্র “নিদা রহিম” হিসেবে অভিনয় করেছেন রাধিকা আপ্তে। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় দুটি সিরিজ লাস্ট স্টোরিজ এবং স্যাক্রেড গেমস-এ অভিনয় করা রাধিকার এটি তৃতীয় সিরিজ। মূলত অন্য সব সিরিজ থেকে Ghoul এর পার্থক্য গড়ে দিয়েছে রাধিকার অনবদ্য অভিনয়৷
বন্দী আবু সাইয়েদ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহেশ বলরাজ। একজন দৃঢ়চেতা বন্দির মনোভাব খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তিনি৷
অন্যদিকে লেফটেন্যান্ট লাক্সমি দাস চরিত্রে অভিনয় করেছেন রত্নাবতী ভট্টাচার্য। লাক্সমি দাস একজন মুসলিম-বিদ্বেষী অফিসার, যে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মুসলমান মানেই জঙ্গি, আতঙ্কবাজ, দেশের প্রতি অপার আনুগত্য থাকার পরেও দেশদ্রোহী। এছাড়া কর্ণেল ডাকুনা চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন মানব কউল।
***
Ghoul শুধু একটি সিরিজ নয়, হররের মোড়কে মোড়ানো বন্দি নির্যাতন ও তার করুন পরিণতির এক ভয়াবহ আখ্যানও৷ ভারতে বর্তমানে যে নিরীহ মুসলিমদের উপর নির্যাতন চলছে তার প্রচ্ছন্ন একটা ছায়াও পাওয়া যায় পুরো সিরিজজুড়ে। সিরিজটি IMDB তে ১০ এ ৭.৩ রিভিউ পেয়েছে প্রথম সপ্তাহে।
সবশেষে বলা যায়, ইসলাম, জঙ্গিবাদ, পরমত সহিষ্ণুতা, অধিকার হরণের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সব মিলিয়ে Ghoul একটি সাধারণ সিরিজের চাইতে বেশি কিছু।