নাইন ইলেভেন: মিথ, ফলস ফ্ল্যাগ, না ইনসাইড জব?

আজ ভয়াল নাইন-ইলেভেন। ২০০১ সালের এদিনে আত্মঘাতী বিমান হামলায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা টুইন টাওয়ার। কে বা কারা এ হামলার নেপথ্যে ছিল তা জানার আগেই পুরোপুরি বদলে যায় পৃথিবী।

কী ঘটেছিলো সেদিন?

সকাল ৮ঃ৪৫- অঘটনের সূচনা

আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৬৭ এর একটি বিমান প্রায় বিশ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল নিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারের ৮০তম তলায় আঘাত করে।

 

মুহূর্তের মধ্যে কয়েকশ’ মানুষ মারা যায়। বহু মানুষ আটকা পড়ে ওপরের তলাগুলোয়। এই ভবন এবং টুইন টাওয়ারের অপর ভবন টাওয়ার সাউথ টাওয়ার থেকে লোকজন সরিয়ে নেয়া শুরু হয়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে।

পরে জানা যায়, বিমানটিতে ১১ জন ক্রুসহ ও ৭৬ জন (সন্ত্রাসী বাদে) যাত্রী ছিলেন। পাঁচ ছিনতাইকারী বিমানটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর বোয়িং ৭৬৭ বিমানটি মূল রাডার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সকাল ৯ঃ০৩- উপর্যুপরি অাঘাত

প্রথমে সবাই ধারণা করেছিলেন, এটা কোনো মাতাল পাইলটের কাণ্ড। কিন্তু ১৮ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ১৭৫ ফ্লাইটের আরেকটি বোয়িং ৭৬৭ বিমান সাউথ টাওয়ারে অাঘাত হানে।

লসঅ্যাঞ্জেলসগামী বিমানটি ৯ জন ক্রু ও ৫১ জন যাত্রী নিয়ে একই বিমানবন্দর থেকে সোয়া ৮টার দিকে যাত্রা শুরু করেছিলো। পাঁচজন ছিনতাইকারী বিমানটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে সকাল ৯টা ৩ মিনিটের সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সাউথ টাওয়ারের ৬০তম তলায় হামলা চালায়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে ভবনের বিভিন্ন অংশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তখনই প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীরা বুঝতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণের সূচনা হয়েছে।

সকাল ৯ঃ৪৫- তৃতীয় বিমানের হামলা

সারাবিশ্বের দৃষ্টি যখন টুইন টাওয়ারের ওপর নিবদ্ধ, তখনই ৯:৪৫ মিনিটে আরেকটি বোয়িং ৭৫৭ আঘাত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদরদপ্তর পেন্টাগনের পশ্চিম অংশে।

হামলাকারী এই বিমানটি ছিলো আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৭৭, যা ওয়াশিংটন ডুলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে লসঅ্যাঞ্জেলসের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বোয়িং ৭৫৭ বিমানটিতে ৬জন ক্রুসহ মোট ৫৩ জন (সন্ত্রাসী বাদে) যাত্রী ছিলেন। পাঁচজন সন্ত্রাসী বিমানটি ছিনতাই করে সকাল ৯টা ৪৩ মিনিটের সময়।

এই হামলায় পেন্টাগনের ১২৫ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন, সেইসাথে বিমানে থাকা সকল আরোহীও।

চতুর্থ বিমানের হামলার ব্যর্থ চেষ্টা

নিউজার্সির ন্যুয়ার্ক বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৯৩ নামে চতুর্থ বিমানটি ৭ ক্রু ও ৩৩জন যাত্রী (সন্ত্রাসী বাদে) নিয়ে উড়েছিল সানফ্রান্সিসকোর উদ্দেশ্যে।

সকাল ৮টা ৪২ মিনিটে যাত্রা করার ৪০ মিনিটের মধ্যেই বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় চার ছিনতাইকারী। কিন্তু বিমানটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে যাত্রা করায় টেলিফোন আলাপে অনেক যাত্রীই জেনে যান টুইন টাওয়ারে হামলার বিষয়টি। তারা বুঝতে পারেন কি ঘটতে চলেছে। কয়েকজন যাত্রী অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ককপিটে হামলা করেন।

একপর্যায়ে ১০:১০ মিনিটে পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে ভূপাতিত হয় বিমানটি। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় একটি প্রাণঘাতী অাক্রমণ।

কেন এই হামলা?

১৯ জন হামলাকারীর সবাই ছিলেন সৌদি আরব এবং অন্য কয়েকটি আরব দেশের নাগরিক। বলা হয় সে সময়ের পলাতক ওসামা বিন লাদেন এ হামলার জন্য অর্থায়ন করেছিলেন। ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সামরিক উপস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্টরা এ হামলা চালিয়েছিলেন বলে বলা হয়।

হামলার পরিকল্পনা

হামলাকারীরা এক বছরের বেশি সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটান এবং এসময় কয়েকটি বাণিজ্যিক ফ্লাইং একাডেমি থেকে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেন। বাকি কয়েকজন হামলার কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। তাদের কাজ ছিল হামলাকারীদের শক্তিবৃদ্ধি করা। তারা সহজেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে বক্স কাটার এবং ছুরি নিয়ে বিমানে উঠতে সক্ষম হন। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় তিনটি বিমানবন্দর থেকে ক্যালিফোর্নিয়াগামী চারটি বিমানে চেপে বসেন তারা। গন্তব্য হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়াকে বেছে নেয়ার কারণ ছিল একটাই, দীর্ঘ যাত্রার জন্য জ্বালানিপূর্ণ থাকে এসব বিমান।

ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার দু’টি ছিলো মজবুত ইস্পাতে নির্মিত, যা ঘন্টায় ২০০ মাইল বেগের বায়ু প্রবাহ, এমনকি বড় অগ্নিকান্ড সহ্য করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ইস্পাতের এই কাঠামোটি জেট ফুয়েল সৃষ্ট উত্তাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়। হামলার ১৫ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ধ্বসে পড়ে সাউথ টাওয়ার। সকাল ১০:৩০ মিনিটে ধ্বসে পড়ে অপর টাওয়ারটিও। ধূলা আর ধোঁয়ার মেঘ ঘিরে ফেলে পুরো এলাকা। উদ্ধারকর্মীরা ভবনটির ওপরের তলাগুলো থেকে হতাহতদের উদ্ধার করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকেন।

প্রায় সাড়ে তিন হাজার নিহতদের মধ্যে ছিলেন চার বিমানের ২৬৫ যাত্রী, বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ও আশপাশের ২ হাজার ৬শ’ ছয়জন, পেন্টাগনের ১২৫ জন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭২ সদস্য ও ৫৫ সামরিক কর্মকর্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের জন্য ইতিহাসের ভয়াবহতম দিন ছিল এটি। একদিনেই মারা যায় ৩৪৩ জন। দশ হাজারের মতো লোক আহত হয়, যাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা ছিল অাশঙ্কাজনক।

তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ

তদন্ত শেষে বলা হয় ভবনটির নকশায় কোন ত্রুটি ছিল না। এ ধরনের হামলার ঘটনা নজিরবিহীন। শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয় স্থানটি খালি করতে। ভবনটির কাঠামো ছিল ‘টিউব ইন টিউব’ পদ্ধতির। প্রতি তলায় জায়গা বাড়ানোর জন্য বাইরের দিকে বেশি পরিমাণে কলাম দেয়া হয়। আর ফ্লোর গুলোয় বেশি পরিমাণে বিম দেয়া হয়। বিমানের আঘাতের পর বিস্ফোরণ স্থলের ওপর ভবনের ওপরের অংশ ধসে পড়ে, প্রচণ্ড উত্তাপে ইস্পাত গলে যায়। ওপরের চাপ নিতে না পেরে ভবন দু’টো নিচের দিকে ধসে পড়ে।

এছাড়া টুইন টাওয়ারসহ কয়েকটি স্থাপনায় বিমান হামলায় একটি দেশের সহায়তার বিবরণ নিয়ে ২০০২ সালে একটি অতি গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই প্রতিবেদনে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলায় জড়িত বিমান ছিনতাইকারীদের একটি বিদেশি সরকার সহায়তা করেছে বলে তথ্য রয়েছে। প্রতিবেদনটি হাউজ সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির জয়েন্ট ইনকোয়ারিতে সংরক্ষিত আছে।

২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি তৈরির তদারকি করেছিলেন সাবেক সিনেটর ও ৯/১১ হামলার ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যান বব গ্রাহাম। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবেই ওই হামলার জন্য সৌদি আরবকে দায়ী করেন।

‘স্পেসেফিক সোর্সেস অব ফরেন সাপোর্ট’ নামের ওই অংশটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ক্লাসিফাইড ঘোষণা করেন, যা পড়তে পারবেন শুধু কংগ্রেস সদস্যরা।

সূদূরপ্রসারী ফলাফল

এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশকে সরিয়ে নেয়া হয় এক গোপন স্থান। সন্ধ্যা সাতটায় হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।

রাত নয়টায় প্রেসিডেন্ট দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন,
“সন্ত্রাসীরা আমাদের সর্বোচ্চ ভবনগুলোর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিত কাঁপাতে পারে নি। এসব কর্মকান্ড ইস্পাত গলিয়ে দিতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়তার যে ইস্পাত রয়েছে তাকে নয়”।

সামরিক পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

“যারা সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত তারা এবং যারা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের মধ্যে কোন তফাত নেই।”

মূলত এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র সূচনা করে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধের”।

***

নাইন ইলেভেনের আগ পর্যন্ত টুইন টাওয়ার ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৌরবের প্রতীক। অাজ সেখানে গেলে দেখা যায়, গভীর এক শূন্যতা কেবল সেই দিনটিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে। অঝোর জলধারা দুই স্থানকে (মেমোরিয়াল নর্থ পুল ও মেমোরিয়াল সাউথ পুল) অবিরাম সিক্ত করে চলেছে। এই নিরবধি জলধারা অার কিছুই নয়, নব্বইয়ের অধিক দেশের ২ হাজার ৯৭৭ জন নিহত মানুষের অাত্মত্যাগ, বেদনা ও অশ্রু।

Post Author: Usamah Ibn Mizan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *