এমন অনেক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত আছেন, যারা নানা ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে’ বিশ্বাস করে থাকেন। তাদের ধারণা: যে ভাবে অনেক বহুলপ্রচারিত ঘটনার কথা লোকে জানেন, আসলে ঘটনাটি সেভাবে ঘটে নি – এর পেছনে অন্য কিছু আছে। শুধু কী তাই, নিজেদের বক্তব্যের সপক্ষে নানা তথ্য-প্রমাণও হাজির করতে সদাপ্রস্তুত থাকেন তারা!
সাম্প্রতিক কালের যেসব ঘটনা নিয়ে এরকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো – যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা বা “টুইন টাওয়ার অ্যাটাক”।
সেদিন উগ্র সন্ত্রাসীরা চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেছিলো, যার দুটি আঘাত করে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনে, একটি ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে, এবং আরেকটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এই ভয়াবহ হামলায় সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়।
বিচিত্র সব ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আছে ওই ঘটনা নিয়ে। কোন কোনটিতে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার নিজেই ওই ঘটনায় জড়িত ছিল। কেউ বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই আক্রমণটি ঘটতে দিয়েছেন। অন্য অনেকে বলেন, ঘটনার পরিকল্পনাতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল।
অাসুন, কিছু চিত্তাকর্ষক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা জানি, যা নিয়ে ১৬ বছর পরও আলোচনা-বিতর্ক শেষ হয় নি:
১.বিস্ফোরক তত্ত্ব
টুইন টাওয়ারে হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ছড়ায় প্রথম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। ডেভিড রস্টচেক নামের এক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লিখলেন, “কেউ কি খেয়াল করেছেন যে ওয়ার্ল্ড টেড সেন্টার ভবনটি বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয় নি? না কি শুধু আমিই এটা বুঝেছি?”
টুইন টাওয়ার ধ্বসের ভিডিওচিত্র পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দুটি বিমান টুইন টাওয়ারের দুটি ভবনে অাঘাত হানার প্রায় ৪০ মিনিট মধ্যে ভবন দুটি ধ্বসে পরে। প্রশ্ন হচ্ছে ধ্বসে পড়তে এতো সময় লাগলো কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্র্যাশ করার পর বিমানে থাকা ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল বিস্ফোরিত হয় এবং এত বেশি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে যে সেটি ভবনের গাঁথুনির রড গলিয়ে দেয় এবং ভবনটি ধ্বসে পড়ে।
আর এখানেই যতো আপত্তি! কেননা জেট ফুয়েলের দহন সর্বোচ্চ ৮১৫° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু লোহার গলনাঙ্ক প্রায় ১৫০০°ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রস্টচেকের বক্তব্য ছিল, ভবনদুটিতে বিমান আঘাত করেছে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক কথা – কিন্তু যে ভাবে টাওয়ার দুটি ভেঙে পড়েছে তার জন্য এর ভেতরে সঠিক জায়গায় বিস্ফোরক বসাতে হতো।
তাহলে কি টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল বোমার বিস্ফোরণে?
২. অত্যন্ত তাপ নিরোধী পাসপোর্ট তত্ত্ব
মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনী টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ তল্লাশির সময় মূল ঘটনাস্থলের অদূরেই একটি পাসপোর্ট খুজে পায়, যা তাদের ভাষ্যমতে হামলাকারী দলের নেতার ব্যবহার করা পাসপোর্ট। মূলত এই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই ৯/১১ হামলার সাথে অারব সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে তারা।
প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনাস্থলে এত বেশি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়েছিলো যে সেটি ভবনের গাঁথুনির রড গলিয়ে দেয় এবং ভবনটি ধ্বসে পড়ে। এই উত্তপ্ত তাপমাত্রার মধ্যেও কীভাবে একটি পাসপোর্ট অক্ষত থাকতে পারলো?
এই তত্ত্ব প্রদানের পর, মার্কিন প্রতিরক্ষা মহলে একটি চুটকি ছড়িয়ে পড়ে। তা হলো, পাসপোর্টটি যদি এতোই তাপসংকুল হয়, তবে এখন থেকে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর ইউনিফর্ম ওই পাসপোর্টের চামড়া দিয়েই বানানো উচিত!
৩. গর্ত তত্ত্ব
হামলার ভিডিওচিত্র এবং ক্ষয়প্রাপ্ত ভবনের ছবি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা দেখান যে ১২৪ ফুট প্রশস্ত একটি বোয়িং-৭৫৭ বিমানের আঘাতে যে পরিমাণ ক্ষতি হওয়ার কথা, পেন্টাগনের হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। যে ভবনে বিমানটি আঘাত করেছে বলে দাবি করা হয় সে ভবনে সৃষ্টি হওয়া গর্তের মাপ ছিল মাত্র ৬৫ ফুট। ১২৪ ফুট বিমানের আঘাতে ৬৫ ফুট গর্ত সৃষ্ট হওয়া কি বিজ্ঞানসম্মত কোনো দাবি?
৪. ইহুদী সংযোগ তত্ত্ব
৯/১১ নিয়ে সৃষ্ট ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত একটি তত্ত্ব। এ বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই যে কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য ।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এ কথা সত্য যে সেপ্টেম্বরের ঠিক ১১ তারিখেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের প্রায় ৪ হাজারের মতো ইহুদী কর্মকর্তা ছুটি নিয়েছিলেন! আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে টুইন টাওয়ারে বিমানের আঘাতের একেবারে প্রথম দিককার ভিডিওগুলোও করেছিলেন কিছু সংখ্যক ইহুদীই!
৫. নকল ওসামা বিন লাদেন তত্ত্ব
হামলার পরপরই আল কায়েদা নেতা লাদেন এই হামলার দায় অস্বীকার করলেও কিছুদিন পরই মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে যেখানে বিন লাদেনকে ঘটনার দায় স্বীকার করতে দেখা যায়। কিন্তু ভিডিওটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ব্যক্তিকে হামলার দায় স্বীকার করতে দেখা যাচ্ছে তার সাথে বিন লাদেনের চেহারার কোনো মিল নেই!
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, কথা বলার সময় লোকটিকে সর্বদা ডান হাত নেড়ে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু এফবিআই এর ওয়েবসাইটে বিন লাদেনের তথ্য ঘেটে জানা যায় তিনি বাঁহাতি। তাই প্রকাশিত সে ভিডিও ফুটেজটিকে ভুয়া বলেই দাবি করেন অনেকেই।
৬. সরকারী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
৯/১১ এর দুবছর আগে গঠিত হয়আমেরিকার আকাশ প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংগঠন “নর্থ আমেরিকান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড” বা ‘নোরাড’। আকাশে যেকোনো ধরণে অবাঞ্ছিত বিমানকে গুলি করে ধ্বংস করার অধিকার রয়েছে নোরাডের। ২০০১ সালের মে মাসে নোরাডের ক্ষমতা থেকে জেনারেলদের সরিয়ে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিকে নোরাডের প্রধান করেন প্রেসিডেন্ট বুশ।
৯/১১’র পর জানা যায় নোরাড অনেক অাগেই এই হামলার অাভাস পেয়েছিলো। তারপরও তারা কেন আক্রমণ চালানেন না? তাহলে কি ডিক চেনিই নোরাডের জেনারেলদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিলেন?
৭. সিম্পসন তত্ত্ব
The Simpsons হচ্ছে আমেরিকায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা (এখনো চলছে, এই বছর ৩০তম সিজন এয়ার হলো) অ্যানিমেটেড কমেডি কার্টুন। ডার্ক কমেডি আর নানা ভবিষ্যত বাণীর জন্য সিম্পসন কার্টুনটি বেশ বিখ্যাত।
টুইন টাওয়ারে হামলার চার বছর অাগে সিম্পসন কার্টুনের “The City of New York vs. Homer Simpson” নামক পর্বে কার্টুনটির অন্যতম মূল চরিত্র বার্ট সিম্পসনের হাতে একটি ম্যাগাজিন দেখা যায় যাতে লেখা ছিলো, “New York 9” এবং লেখার পাশে থাকা দুইটি ভবনকে অনেকটা “11” সংখ্যার মতো দেখাচ্ছিলো।
অনেক কন্সপিরেসি থিওরিস্ট এর মতে, এই পর্বে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ঘটতে চলা এই মর্মান্তিক হামলার ইঙ্গিত দেয়া হয়৷ প্রশ্ন হচ্ছে একটি কার্টুন প্রতিষ্ঠান কীভাবে অান্দাজ করতে পারলো এমন একটি অাক্রমণ ঘটতে চলেছে?
৮. স্টক মার্কেট তত্ত্ব
৯/১১ এর আগে মার্কিন স্টক মার্কেটে হঠাৎ করেই আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমানগুলোর শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেঁড়ে যায়। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সেই বিমানগুলোর মধ্যে বিধ্বস্ত প্রতিটি বিমানই ছিল!।
তাহলে কি স্টক মার্কেটের ভেতরের লোকজন জানতেন, যে আমেরিকান এয়ারলাইন্সে কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে?
৯. ভুয়া ফোনকল তত্ত্ব
৯/১১ তে বিধ্বস্ত প্রতিটি বিমানের মধ্য থেকেই এক বা একাধিক ফোন কল আসার কথা সকলেই জানেন। তার মধ্যে ফ্লাইট-৯৩ থেকে একাধিক যাত্রী তাদের পরিবারের কাছে ফোন করেছিল বলে দাবি করা হয়।
কিন্তু এখানেও সন্দেহবাদীদের যতো সন্দেহ! তারা প্রশ্ন তুলেন, বিমানটি যে উচ্চতায় এবং যে গতিতে চলছিল, তাতে করে এর ভেতর থেকে ফোন দেয়া সম্ভব ছিল কি?
কেন এতো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব? কারণটা বিশেষজ্ঞ থেকেই জানা যাক।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো ছড়িয়েছে এই জন্য যে মাত্র কয়েকজন লোক মিলে অতিসাধারণ অস্ত্র দিয়ে এরকম ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে তা লোকে বিশ্বাসই করতে পারে না।
কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারেন ডগলাস বলেন,
“যখন কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তখন লোকেরা এর একটা ব্যাখ্যা পেতে চায়, কিন্তু অনেকসময়ই সরকারি ব্যাখ্যা লোককে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তারা চায়, ঘটনা যে মাপের – ব্যাখ্যাটাও সেই মাপের হতে হবে। সেটা না পেলেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়।”
অন্যদিকে অনলাইন জগতে এসব তত্ত্ব ক্রমাগত প্রচার হতে থাকে। তাই এগুলো দেড় দশক পরও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।