অক্ষয় কুমার: বলিউডের অবিসংবাদিত ‘খিলাড়ি’

বয়স তার পঞ্চাশ ছুই ছুই। হতে চেয়েছিলেন একজন মডেল। কাজ করেছেন স্টান্টম্যান, মার্শাল অার্ট প্রশিক্ষক, এমনকি হোটেলের রাধুনী হিসেবেও৷ বাড়ি অমৃতসর থেকে মুম্বাইয়ের দূরত্ব প্রায় সতেরোশো কিলোমিটার। এই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে কাজ করতে হতো তাকে। বিমানের একটি ফ্লাইট মিস করে জীবনের গতি ঘুরে যায় তার৷ চলে অাসেন অভিনয় জগতে। অাজ ফোর্বসের মতে, সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয় করা অভিনেতাদের মধ্যে তিনি দশম।

বলছিলাম বলিউডের অবিসংবাদিত “খিলাড়ি” রাজিব হরি ওম ভাটিয়ার কথা। অবশ্য দর্শকরা চেনেন তাকে ভিন্ন নামে। সেটি হল অক্ষয় কুমার।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা

শৈশবের অক্ষয় কুমার

অক্ষয় কুমারের জন্ম সালের ৯ই সেপ্টেম্বর, পাঞ্জাবের অমৃতসরে। তার বাবার নাম হরি ওম ভাটিয়া এবং মায়ের নাম অরুনা ভাটিয়া। অক্ষয়ের বাবা পেশায় একজন মিলিটারি অফিসার ছিলেন।

তার বেড়ে ওঠা দিল্লির চাঁদনী চক এলাকায়। এরপর তিনি চলে অাসেন মুম্বাইয়ের কলিওয়ারাতে। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ ছিলো পাঞ্জাবী।

অক্ষয়ের পড়ালেখার সূচনা হয় ডন বস্কো বিদ্যালয়ে। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন মুম্বাইয়ের গুরু নানক খালসা কলেজে। কিন্তু একবছর পড়াশোনা করে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে অক্ষয় মার্শাল অার্ট শিখতে ব্যাংকক পাড়ি জমান।

তায়কোয়ান্দোতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার পরে সেখান থেকে চলে আসেন থাইল্যান্ড-এ। সেখানে তিনি মুই থাই শিখার পর প্রধান ওয়েটার এর কাজ করেন, তিনি কিছুদিন বাংলাদেশেও কাজ করেছিলেন । যখন তিনি মুম্বাই এ ফিরে আসেন, তখন তিনি মার্শাল আর্ট শেখানো শুরু করেন। তার এক ছাত্র, ফটোগ্রাফার, কুমারকে মডেলিং করার জন্য পরামর্শ দেয়, যা তার চলচ্চিত্রে অভিষেকের প্রথম সোপানটি তৈরি করে দেয়।

অভিনয় জগতে অাবির্ভাব

অভিনয়জীবনের শুরুতে অক্ষয় কুমার

১৯৯২ সালের কথা। অক্ষয় তখনো অভিনয়ের জগতে পা রাখেননি। বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিচ্ছিলেন মডেলিং এর দু একটি কাজের জন্য। এমন সময়ে তার সামনে সুযোগ আসে বেঙ্গালুরে একটি শো-তে মডেলিং করতে যাবার। অক্ষয়ের ফ্লাইট ছিল ভোর ছয়টায়। কিন্তু অক্ষয় ভেবেছিলেন, তার ফ্লাইট সন্ধ্যা ছয়টায়। সকাল ৬ টায় বিমানবন্দর থেকে ফোন আসে তার কাছে। অক্ষয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।

ফ্লাইটি ধরবার জন্য রওনা দিয়ে তিনি বারবার অনুরোধ করতে থাকেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু শতো কাকুতি-মিনতিতেও কোনো কাজ হয়নি।ফ্লাইট মিসের দুঃখ নিয়ে অক্ষয় পৌছান প্রমোদ চক্রবর্তীর স্টুডিওতে।তিনি বলেন,

“হঠাৎ আমার নটরাজ স্টুডিওতে যাওয়ার কথা মনে পড়ল। প্রয়াত প্রমোদ চক্রবর্তীর কোম্পানির মেকআপ ম্যান আমাকে বলেছিলেন, ‘নায়ক হতে চাও?’ আমি সেখানেই চলে গেলাম। আমাকে ভেতরে ডাকা হলো এবং অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে প্রথম চেকটি সই করতে দিলেন। পরপর তিনটি ছবির জন্য সই করলাম। প্রথমটি পাঁচ হাজার, দ্বিতীয়টি এক লাখ এবং তৃতীয়টি দেড় লাখ টাকার চেক। চলচ্চিত্র তিনটি ছিল, ‘দিদার’, ‘খিলাড়ি’ ও ‘মি. বন্ড’।”

সেদিনের সেই ফ্লাইট মিস নিয়ে অক্ষয়ের মনে কোনো দুঃখ নেই। তিনি বলেন,

‘সত্যিকার অর্থে যা ঘটে ভালোর জন্যই ঘটে। আমি সব সময় ভাবি, সেদিন আমি যদি বেঙ্গালুরুতে চলে যেতাম, খুব ক্ষতি হয়ে যেত। হয়তো এখন কোথাও অবসরপ্রাপ্ত মডেল হয়েই থাকতাম।’

অভিনয় জীবন

অক্ষয়ের সংগ্রামের গল্পটা কম বেশি সবারই জানা। ক্যারিয়ারের একেবারে শুরুর দিকে কোনোভাবেই বাজিমাৎ করতে পারছিলেন না। ১৯৯১ সালে তার ‘সুগান্ধ’ ও ‘ড্যান্সার’ সিনেমা দু’টি মুক্তি পায়। কোনোটাই অক্ষয়কে নায়কের খ্যাতি এনে দিতে পারেনি।

নব্বইয়ের দশকে ‘খিলাড়ি’, ‘মোহরা’, ‘ইয়ে দিল্লাগি’ সিনেমাগুলো একটু একটু করে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেন “আক্কি”। ওই সময় খিলাড়ি সিরিজের মধ্য দিয়ে অ্যাকশন নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান অক্ষয়। তবে, তাতে কী! তখন তো বলিউডে খানদের দুদর্ন্ড প্রতাপ! সাথে সঞ্জয় দত্ত, গোবিন্দদের একচেঁটিয়ে রাজত্ব – এর মধ্যে অক্ষয়ের এক নম্বর হয়ে ওঠার সুযোগ কোথায়!

তার আসল লড়াইটা শুরু হয় ২০০০ সালের পর থেকে। অ্যাকশন জনরার থেকে বের হয়ে এসে কখনো কমেডি, কখনো রোমান্টিক সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মন জয় করা শুরু করেন। ‘হেরাফেরি’, ‘ধাড়কান’, ‘আঁখে’র মত সিনেমাগুলো তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।

‘হেরা ফেরি’ ছবির দৃশ্যে অক্ষয় কুমার, সুনীল শেট্টি ও পরেশ রাওয়াল

অক্ষয় কুমার স্টারডমের স্বাদ পেতে শুরু করেন ২০০৭ থেকে ২০১০ সময়কালে। এসময় তার বেশ কিছু ছবি প্রথম দিনেই বক্স অফিস মাতিয়ে দেয়। ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সিং ইজ কিং’ ছিল রেকর্ড ব্রেকার। ‘কামবাখত ইশক’, ‘ফির হেরা ফেরি’ এ দুটো মুভিও প্রথমদিনেই রেকর্ড পরিমাণ দর্শক টানতে সক্ষম হয়।

আর বর্তমান সময়ে অক্ষয় সত্যিকার অর্থেই ছাড়িয়ে গেছেন খানদের। ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। রুস্তমের সুবাদে তিনি পেয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া তার ছবিগুলো ভারতের মধ্যে ১৫০ কোটি রুপির বেশি আয় করে।

“রাজীব” থেকে “অক্ষয়ে” পদার্পণ কীভাবে রাজীব হরি ওম ভাটিয়া হয়ে উঠলেন অক্ষয় কুমার? এ প্রশ্নটি অনেকেরই। এটির জবাব খোদ অক্ষয় থেকেই জানা যাক। অক্ষয় বলেন,

‘১৯৮৭-তে মহেশ ভাট পরিচালিত ‘আজ’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করি। কুমার গৌরবও ছিলেন সেই ছবিতে। ছবিতে গৌরবের নাম হয়েছিল অক্ষয়। মাত্র সাড়ে ৪ সেকেন্ডের অভিনয় ছিল আমার। গৌরবকে লক্ষ্য করতাম। তাঁর অভিনয় মন দিয়ে দেখতাম। জানি না, হঠাৎ এক দিন কী হল, সোজা চলে গেলাম আদালতে। সেখানে গিয়ে নামটাই বদলে ফেললাম। নতুন নাম হল অক্ষয় কুমার।’

পারিবারিক জীবন

স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে অক্ষয় কুমার

অক্ষয় ২০০০ সালের জানুয়ারী অভিনেত্রী টুইঙ্কেল খান্নাকে বিয়ে করেন। টুইঙ্কেল কিংবদন্তি নায়ক রাজেশ খান্না ও খ্যাতনামা অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়ার কন্যা। তাদের সংসারে রয়েছে পুত্র অারাভ ও কন্যা নিতারা।

টুইঙ্কেলের সঙ্গে তাঁর বিয়েটাও অদ্ভুত এক ঘটনা। ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনের কভারের জন্যে ফটোশুট করতে গিয়ে টুইঙ্কেলের সাথে পরিচয় হয় অক্ষয়ের। দেখেই প্রেমে পড়ে যান তিনি। যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট!

২০০০ সালে টুইঙ্কেলের ‘মেলা’ সিনেমা মুক্তি পাবার কথা। সেই সিনেমা নিয়ে টুইঙ্কেল ছিলেন দারুণ অাশাবাদী। কিন্ত অক্ষয় বলে দিলেন, ‘মেলা’ ফ্লপ হবে। দুজনে বাজি ধরলেন, মেলা সিনেমাটা হিট হলে অক্ষয় আর টুইঙ্কেলকে বিরক্ত করবেন না, আর যদি সিনেমাটা সত্যিই ফ্লপ হয়, টুইঙ্কেল রাজি হবেন অক্ষয়কে বিয়ে করতে। বিধাতার লিখন না যায় খন্ডণ, মেলা ঠিকই ফ্লপ হলো। পরে দুজনের পারিবারিক সম্মতিতেই পরে তাঁদের বিয়ে হয়!

চলচ্চিত্র জগতে অভিষেকটা নায়ক হিসেবে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলে ফেলেছেন অক্ষয়। বর্তমানে অক্ষয়ের ক্যারিয়ারের দারুণ একটি অধ্যায় চলছে। কারণ অক্ষয় নিজেকে ‘পরীক্ষা’ করছেন। তিনি বিভিন্ন ধারার সিনেমা হাতে নিচ্ছেন, এবং সফলও হচ্ছেন। নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অন্যরকম উচ্চতায়।

গত এক বছরে অক্ষয়ের আয় ৩৫.৫ মিলিয়ন ডলার বা ২২৭.৫ কোটি রুপি। কে ভেবেছিল একসময় যার টানা ১৩ টি সিনেমা ফ্লপ হবে, তিনি একদিন এই অবস্থানে পৌঁছাবেন!

Post Author: RK Desk

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *