একজন “সব্যসাচী” সব্যসাচীর কথা

কিছু কিছু শিল্পী অাছেন, যারা তাদের অভিনয় দিয়ে অামাদের এমনভাবে মুগ্ধ করে রাখেন, যে অামরা ভুলেই যাই, টেলিভিশনের পর্দার বাইরেও তাদের একটা জীবন অাছে। কখনো কখনো তাদের বাস্তব জীবনের অস্তিত্ত্বের চেয়ে পর্দার সামনে থাকা চরিত্রটিই অামাদের মানসপটে বেশি দাগ কেটে বসে। একারণেই টেলিভিশনের পর্দায় রোয়ান অ্যাটকিনসনকে দেখে অামরা চিৎকার করে উঠি, “অারে, এটাতো মিস্টার বিন!”, অাবার হ্যারি পটারের অাসল নাম যে ড্যানিয়েল র‍্যাডক্লিফ, অনেকেই তা স্বীকার করতে চাইনা।
এমনই একজন মানুষ হলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী, যিনি টিভি-সিনেমার পর্দায় করা চরিত্রটির মাধ্যমে মানুষের মনে ঠাই করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কিংবদন্তির সম্মান। অনেকের হয়তো নামটা অপরিচিত ঠেকতে পারে। কিন্তু একটি শব্দই এই সব্যসাচীকে সবার কাছে পরিচিত করানোর জন্য যথেষ্ট।
অার তা হলো, ‘ফেলুদা’।
হ্যা, ফেলুদার নাম শুনলে সৌমিত্র চ্যাটার্জির পর চোখ বন্ধ করে যার ছবি সবার আগে মানসপটে ভেসে ওঠে, বলা হচ্ছিলো সেই শক্তিমান অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তীর কথা। মঞ্চ নাটক থেকে শুরু করে টেলিভিশন আর চলচ্চিত্র জগৎ মাতিয়ে রাখা এই অভিনেতা বাংলা সাহিত্যের খুব জনপ্রিয় একটি গোয়েন্দা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছেন।

প্রথম জীবন

সব্যসাচী চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৫৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর কলকাতায়। ৬২ বছর বয়সী এই অভিনেতার বাবার নাম জগদীশ চন্দ্র চক্রবর্তী আর মায়ের নাম মনিকা চক্রবর্তী। বাবা-মা ছোটবেলায় তাঁকে আদর করে “বেণু” বলে ডাকতেন। তাই আজও চলচ্চিত্র জগতে তাঁকে এই নামেই সম্বোধন করা হয়। ঝাড়া প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার সব্যসাচী কন্যা রাশির জাতক।
১৯৭৫ সালে তিনি দিল্লির অ্যান্ড্রু কলেজ থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। দিল্লির বিখ্যাত হন্সরাজ কলেজ থেকে নেন বিএসসি ডিগ্রি। ১৯৭৮ সালে তিনি দিল্লিতে এএমআই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

অভিনয় জগতে অাবির্ভাব

১৯৮৭ সালে দূরদর্শন চ্যানেলে প্রচারিত টেলিভিশন সিরিজ ‘তেরো পার্বণ’ এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো সবার নজরে পড়েন সব্যসাচী। পশ্চিমবাংলার ঘরে ঘরে এক পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।
তবে সব্যসাচীর সবথেকে উল্লেখযোগ্য চিত্রায়ন হলো সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’। তার অাগে অারেক শক্তিমান অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি এই চরিত্রটিতে অভিনয় করে গিয়েছিলেন। কিন্তু সৌমিত্রে অসাধারণ ফেলুদা চিত্রায়নের পরেও তাঁকে বাঙালি দর্শক ফেলুদা হিসাবে যথেষ্ট সমাদরের সাথে গ্রহণ করে নেয়।

‘সব্যসাচী’ থেকে ‘ফেলুদা’

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ফেলুদা সিরিজের ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এ সৌমিত্রের অসাধারণ অভিনয় দেখে সব্যসাচী ফেলুদা চরিত্রটির প্রতি অাকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অাশির দশকের শেষের দিকে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করেন এবং চরিত্রটিতে অভিনয়ের অাগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান ‘জটায়ু’ চরিত্রে অভিনয় করা সন্তোষ দত্ত ১৯৮৮ সালে মারা যাওয়া সত্যজিৎ ফেলুদাকে নিয়ে অার কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের অাগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই তিনি সব্যসাচীকে তার ছেলে সন্দীপ রায়ের সাথে দেখা করার পরামর্শ দেন।
১৯৯৪ সালে সন্দীপ রায় সব্যসাচীকে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। সব্যসাচী তখন বেশ কিছু নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ইতোমধ্যে বেশ নাম-যশ কামিয়ে ফেলেছেন। তিনি এ প্রস্তাব পাওয়া মাত্র হাতে লুফে নেন। কেননা ফেলুদা চরিত্রটি তাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল, যে তিনি চরিত্রটির প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে সব্যসাচী অভিনীত ফেলুদা সিরিজের প্রথম টিভি ফিল্ম ‘বাক্স রহস্য’ মুক্তি পায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফেলুদাকে নিয়ে দশটি টিভি ফিল্ম বানানো হয়৷


২০০২ সালে সন্দীপ রায় পরিচালিত ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় ফেলুদা হিসেবে সব্যসাচীর অভিষেক ঘটে। এটি ছিলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ও সৌমিত্র চ্যাটার্জি অভিনীত জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯) এর সিকুয়েল। বোম্বাইয়ের বোম্বেটের ব্যাপক সাফল্যের পর ২০১১ সাল পর্যন্ত ফেলুদার ওপর অারো চারটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এগুলো হল, কৈলাসে কেলেঙ্কারি (২০০৭) টিনটোরেটর যিশু (২০০৮) ও রয়েল বেঙ্গল রহস্য (২০১১)।
এ পর্যন্ত সব্যসাচী অভিনীত পাঁচটি ফেলুদা চলচ্চিত্রে ‘জটায়ু’ চরিত্রে যথাক্রমে রবি ঘোষ, অনুপ কুমার এবং বিভু ভট্টাচার্য অভিনয় করেছেন। অার ‘তোপসে’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরমব্রত।
২০১১ সালের বড়দিনে মুক্তি দেয়া হয় ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ চলচ্চিত্রটি। ফেলুদা হিসেবে এটিই ছিল সব্যসাচীর আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ চলচ্চিত্র । পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ‘ডাবল ফেলুদা’ সিনেমায় ফেলুদার পঞ্চাশ বছর উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ আবারো ফেলুদার চরিত্রে অবতীর্ণ হন সব্যসাচী।

একনজরে অভিনয় জীবন

বাংলা সিরিয়াল- তেরো পার্বণ, সেই সময়, উড়নচন্ডী
অন্যান্য বাংলা সিনেমা- অন্তর্ধান (১৯৯২), শ্বেত পাথরের থালা (১৯৯৪), সিনেমায় যেমন হয়, (১৯৯৪), দামু (১৯৯৭), সম্প্রদান, ১৯৯৭), এক যে আছে কন্যা (২০০০), মহুলবনীর সেরেং (২০০৪),ওয়ারিশ (২০০৪), শতাব্দির গল্প (২০০৪), সংঘর্ষ (২০০৪), নিশিযাপন (২০০৫), মন্ত্র (২০০৫), মানুষ ভূত (২০০৬), বালিগঞ্জ কোর্ট (২০০৭), ভালোবাসা ভালোবাসা (২০০৮), অংশুমানের ছবি (২০০৯), পিয়ালির পাসওয়ার্ড (২০০৯), 033 (২০০৯), থানা থেকে আসছি (২০০৯), হেমলক সোসাইটি (২০১২), হলুদ পাখির ডানা (২০১২), কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস (২০১৫)
হিন্দি সিনেমা – দিল সে (১৯৯৮), খাকি (২০০৪), পরিণীতা (২০০৫), মাইকেল (২০১৩)।

পুরস্কার ও সম্মাননা

সব্যসাচী চক্রবর্তী ১৯৯৬ সালে “কাকাবাবু হেরে গেলেন” চলচ্চিত্রের জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন হতে সেরা অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন। একই সংগঠন থেকে তিনি ১৯৯৫,২০০০ এবং ২০০৩ সালে সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেছেন।
এছাড়াও “এক যে অাছে কন্যা” অভিনয়ের জন্য ২০০২ সালে এবং ২০০৪ সালে “বোম্বাইয়ের বোম্বেটে” চলচ্চিত্রের জন্য অানন্দলোক সম্মাননা লাভ করেন তিনি।

পারিবারিক জীবন

১৯৮৬ সালে তিনি মিঠু চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন; যিনি বাংলা টিভি জগতে একজন জনপ্রিয় মুখ। তাঁদের দুই ছেলে গৌরব ও অর্জুন; যারা আগামী দিনের মেধাবী অভিনেতা।
অভিনয় ছাড়াও প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা রয়েছে। বন্যপ্রাণীর ছবি তোলায় তার আগ্রহ একেবারে আকাশচুম্বী।


নিজের করা চরিত্রটি নিয়ে সব্যসাচী ছিলেন পরিতৃপ্ত। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

“ফেলুদা সবসময় মেরুদণ্ড সোজা করে বসবে, পায়ের উপর পা আড়াআড়ি করে তুলবে, কথা বলার আগে সোজা চোখের দিকে তাকাবে। সে কখনো বলবে না “এটা আমাকে দিন”, বরং সে বলবে “এটা কি আমাকে দেয়া যায়?” ‘অবশ্য’ কথাটিকে সে ‘অবিশ্যি’ বলবে। প্রচুর চা পান করবে, সাথে থাকবে চানাচুর। কড়া পাকের সন্দেশ, খয়ের ছাড়া মিষ্টি পান খুব পছন্দ তার। ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে জানে। আর তিনটি ভাষায় ভীষণ রকমের পারদর্শী সে- বাংলা, হিন্দি আর ইংরেজি।”

৬২ বছরে পা দেয়া এই শক্তিমান অভিনেতা এখনো ছোট ও বড়, উভয় পর্দায় সমান প্রতাপের সাথে অভিনয় করে চলেছেন। তার অভিনয় দেখে দর্শকদের মুখ থেকে এখনো অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে অাসে, “সব্যসাচী ‘সব্যসাচী” বটে!”

Post Author: Usamah Ibn Mizan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *