দ্যা “অানপ্যারালাল” সালমান শাহ

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সার্থক নায়ক কে? প্রশ্নটি করলে যারা ষাটের দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত, তাদের অনেকেই রহমান, নাদিম, রাজ্জাক, সোহেল রানা, ফারুক, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখের কথা উল্লেখ করবেন। কিন্তু এসকল জনপ্রিয় নায়কের যুগের পর ঢালিউডের আকাশে ধূমকেতুর মতো যার আবির্ভাব ঘটেছিলো তিনি অার কেউ নন, সালমান শাহ। মাত্র তিন বছরের অভিনয় জীবনে বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে ধূমকেতুর মতো এখনো জ্বল জ্বল করে জ্বলেছেন তিনি।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

সালমান শাহের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের বছরে। ১৯৭১ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সিলেট জেলায় অবস্থিত জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন এই মহানায়ক। তাঁর বাবার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মায়ের নাম নীলা চৌধুরী। সন্তানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। তাঁর অাসল নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন, কিন্তু চলচ্চিত্র জীবনে তিনি সবার কাছে সালমান শাহ বলেই পরিচিত ছিলেন।

সালমান পড়াশুনার হাতেখড়ি হয় খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুলে। একই স্কুলে চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার সহপাঠী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। পরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি ও ধানমন্ডির মালিকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম. পাস করেন।

অভিনয় জগতে অাবির্ভাব

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে সালমান শাহ চলচ্চিত্রে অভিনয় জগতে অাবির্ভাব ঘটে। সোহানুর রহমান সোহানসনম বেওয়াফা ‘দিল’ ও কেয়ামত সে কেয়ামত তক এর যে কোন একটির বাংলা পুনঃনির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি উক্ত ছবিগুলোর জন্য উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা খুঁজে না পেয়ে সম্পূর্ণ নতুন মুখ দিয়ে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। নায়িকা হিসেবে মৌসুমীকে নির্বাচিত করলেও নায়ক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন নায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীর সালমান শাহের সন্ধান দেন। প্রথম দেখাতেই তাকে পছন্দ করে ফেলেন পরিচালক। তাকে সনম বেওয়াফা ছবির জন্য প্রস্তাব দেন, কিন্তু যখন সালমান শাহ কেয়ামত সে কেয়ামত তক ছবির কথা জানতে পারেন, তখন তিনি উক্ত ছবিতে অভিনয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। তাঁর কাছে কেয়ামত সে কেয়ামত তক ছবি এতই প্রিয় ছিলো যে তিনি মোট ২৬ বার ছবিটি দেখেছেন বলে পরিচালক কে জানান।

শেষ পর্যন্ত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান তাঁকে নিয়ে কেয়ামত থেকে কেয়ামত চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার নাম ইমন নাম পরিবর্তন করে সালমান শাহ রাখা হয়। পরে মৌসুমীর বিপরীতে তিনি আরও তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ছবি তিনটি হল অন্তরে অন্তরে (১৯৯৪), স্নেহ (১৯৯৪) ও দেনমোহর (১৯৯৫)। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘অন্তরে অন্তরে’ হিন্দি চলচ্চিত্র ‘আও পেয়ার করে’র আনঅফিসিয়াল রিমেক, ‘স্নেহ’ পরিচালনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও শফি বিক্রমপুরী পরিচালিত ‘দেনমোহর’ হিন্দি চলচ্চিত্র সনম বেওয়াফা অফিসিয়াল রিমেক।

সালমান ১৯৮৫ সালে বিটিভির আকাশ ছোঁয়া নাটক দিয়ে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেন। পরে দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), নয়ন (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬) নাটকে অভিনয় করেন। নয়ন নাটকটি সে বছর শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া তিনি ১৯৯০ সালে মঈনুল আহসান সাবের রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত পাথর সময় ও ১৯৯৪ সালে ইতিকথা ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন।

তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র জহিরুল হক ও তমিজউদ্দিন রিজভী পরিচালিত ‘তুমি আমার’ ব্যবসাসফল হয়। পরিচালক জহিরুল হক চলচ্চিত্রটির কিছু অংশ নির্মাণ করার পর মারা যান। পরে তমিজউদ্দিন রিজভী বাকি কাজ শেষ করেন। এই চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেন শাবনূর। পরে তার সাথে জুটি বেধে একে একে সুজন সখি (১৯৯৪), বিক্ষোভ (১৯৯৪), স্বপ্নের ঠিকানা (১৯৯৪), মহামিলন (১৯৯৫), বিচার হবে (১৯৯৬), তোমাকে চাই (১৯৯৬), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬), জীবন সংসার (১৯৯৬), চাওয়া থেকে পাওয়া (১৯৯৬), প্রেম পিয়াসী (১৯৯৭), স্বপ্নের নায়ক (১৯৯৭), আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭), বুকের ভিতর আগুন (১৯৯৭) সহ মোট ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সবকটি ছবিই ব্যবসাসফল হয়।

অভিনীত ছবি:

• কেয়ামত থেকে কেয়ামত – ১৯৯৩ সালের ২৫ মার্চ
• তুমি আমার – ১৯৯৪ সালের ২২ মে
• অন্তরে অন্তরে – ১৯৯৪ সালের ১০ জুন
• সুজন সখী – ১৯৯৪ সালের ১২ আগস্ট
• বিক্ষোভ – ১৯৯৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর
• স্নেহ – ১৯৯৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর
• প্ৰেমযুদ্ধ – ১৯৯৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর
• কন্যাদান – ১৯৯৫ সালের ৩ মার্চ
• দেনমোহর – ১৯৯৫ সালের ৩ মার্চ
• স্বপ্নের ঠিকানা – ১৯৯৫ সালের ১১ মে
• আঞ্জুমান – ১৯৯৫ সালের ১৮ আগস্ট
• মহামিলন – ১৯৯৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর
• আশা-ভালোবাসা – ১৯৯৫ সালের ১ ডিসেম্বর
• বিচার হবে- ১৯৯৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি
• এই ঘর এই সংসার – ১৯৯৬ সালের ৫ এপ্রিল
• প্রিয়জন – ১৯৯৬ সালের ১৪ জুন
• তোমাকে চাই – ১৯৯৬ সালের ২১ জুন
• স্বপ্নের পৃথিবী – ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই
• সত্যের মৃত্যু নেই – ১৯৯৬ সালের ৪ অক্টোবর
• জীবন সংসার – ১৯৯৬ সালের ১৮ অক্টোবর
• মায়ের অধিকার – ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর
• চাওয়া থেকে পাওয়া – ১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর
• প্রেম পিয়াসী – ১৯৯৭ সালের ১৮ এপ্রিল।
• স্বপ্নের নায়ক – ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই
• শুধু তুমি – ১৯৯৭ সালের ১৮ জুলাই
• আনন্দ অশ্রু – ১৯৯৭ সালের ১ আগস্ট
• বুকের ভেতর আগুন – ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর

সাংসারিক জীবন

সালমান শাহ ১২ আগস্ট ১৯৯২ তাঁর খালার বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হককে বিয়ে করেন। সামিরা হক ছিলেন একজন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী। তিনি সালমানের ২টি চলচ্চিত্রে তাঁর পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন।

মৃত্যু

সালমান শাহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে তাঁর নিজ বাস ভবনে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। ময়না তদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য এখনো কাটেনি। অনেকেই সালমান শাহ-এর মৃত্যুর জন্য তাঁর স্ত্রী সামিরার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন, এমনকি পরবর্তীকালে সালমানের পরিবারের পক্ষ থেকে স্ত্রী সামিরা ও আরো কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয় কিন্তু পরে এই মামলার আর কোন অগ্রগতি হয়নি ফলে সালমানের মৃত্যু নিয়ে রহস্য আর উদঘাটিত হয়নি।

মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেও মৃত্যু নিয়ে সালমান শাহ বলেছিলেন, ‘এখনই এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নই,কাম্যও নয়। শুধু আমার নয়, কারও ভাগ্যে যেন বিধাতা অকাল মৃত্যু না লিখেন।’ বেঁচে থাকার জন্য যার এতো আকুতি ছিল, তিনি কী করে আত্ম অভিমানী হয়ে এভাবে চলে গেলেন, এ প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন আন প্যারালাল, মৃত্যুর পরেও হয়ে আছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক। সালমানের অভিনয় স্টাইল, পর্দায় তার সপ্রতিভ উপস্থিতি আর নায়কোচিত ইমেজ আজও অন্য তারকাদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে আছে। তাই বলা যায়, সালমান শাহ ছিলেন অভিনয়ে, আছেন হৃদয়ে, থাকবেন অনন্তকাল।

এক নজরে সালমান শাহ:

• আসল নাম : চৌধুরী সালমান শাহরিয়ার ইমন
• জন্ম : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, রবিবার
• বাবা : কমর উদ্দিন চৌধুরী
• মা: নীলা চৌধুরী
• স্ত্রী : সামিরা
• উচ্চতা : ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি
• রাশি : বৃশ্চিক
• প্রথম চলচ্চিত্র : কেয়ামত থেকে কেয়ামত
• শেষ ছবি : বুকের ভেতর আগুন
• প্রথম নায়িকা: মৌসুমী
• সর্বাধিক ছবির নায়িকা : শাবনূর (১৪টি)
• মোট ছবি : ২৭টি
• বিজ্ঞাপনচিত্র :মিল্ক ভিটা, জাগুয়ার কেডস, গোল্ড স্টার টি, কোকাকোলা
• ধারাবাহিক নাটক : পাথর সময়, ইতিকথা
• একক নাটক : আকাশ ছোঁয়া, দোয়েল, সব পাখি ঘরে ফেরে, সৈকতে সারস, নয়ন, স্বপ্নের পৃথিবী
• মৃত্যু: ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬, শুক্রবার

Post Author: Usamah Ibn Mizan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *