বঙ্গবন্ধু ও ডেভিড ফ্রস্ট-এর আলাপচারিতা

১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে ২৫শে মার্চে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে শুরু করে, বঙ্গবন্ধুর অতীত রাজনৈতিক সংগ্রাম, ইয়াহিয়া, ভূট্টো ও পাকিস্তানিদের প্রতি তাঁর মনোভাব এবং বিশ্ববাসীর প্রতি এক নতুন দেশের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান সবই প্রকাশ পেয়েছিল। তাদের মধ্যকার এই আলাপচারিতা আজকে তুলে ধরছি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ সেই রাতের কথা বলুন সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সাথে যখন আলোচনা চলছিল আর সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল সেই রাতের কথা বলুন, ২৫শে মার্চ, রাত ৮টা, আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন, সেই বাড়ি থেকেই আপনাকে গ্রেফতার করা হলো শুনেছিলাম টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল যে সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও না যেয়ে গ্রেফতার বরণ করলেন? এই সিদ্ধান্ত কেন?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, সে এক গল্প। সেটা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী আমার বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ওরা প্রথমে ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে আমাকে হত্যা করে প্রচার করে দেবে যে, আমার সাথে রাজনৈতিক আপস আলোচনার মাঝখানে বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বেরুনো-না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী বর্বর। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। তাই স্থির করলাম, আমি মরি ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনি তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন

বঙ্গবন্ধুঃ কলকাতা শুধু নয়, ইচ্ছা করলে আমি যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম, কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা, আমি সংগ্রাম করব, মৃত্যুবরণ করব, পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহবান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল কারণ, এই ঘটনাই বিগত নয়মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে তাদের কাছে এখন আপনি প্রায় ঈশ্বরসম

বঙ্গবন্ধুঃ আমি সেটা বলি না। কিন্তু এটা সত্য তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম, তাদের জীবন রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বররা আমাকে সে রাতে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিলো।

আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে আমার ৯০ বছর বয়সী পিতা আর ৮০ বছরের মাতা ছিলেন, সে বাড়িও ধ্বংস করে দিলো। সৈন্য পাঠিয়ে বাবা-মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তাদের চোখের সামনে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো, বাবা-মার আর কোনো আশ্রয় ছিল না। ওরা সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে, জীবনব্যাপী একটি শক্তিশালী সংগঠন আমি গড়ে তুলেছিলাম, জনগণ যার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়ত এটাই আমার শেষ নির্দেশ, কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে, লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনাকে ঠিক কীভাবে ওরা গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত দেড়টা, তাই না? তখন কী ঘটল?

বঙ্গবন্ধুঃ প্রথমে ওরা আমার বাড়ির উপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।

ডেভিড ফ্রস্টঃ ওরা যখন এলো আপনি সেসময় বাড়ির কোন জায়গাটাতে ছিলেন?

বঙ্গবন্ধুঃ এখানে, এটা আমার শোবার ঘর, আমি এই ঘরেই তখন বসেছিলাম। (আঙুল তুলে দেখিয়ে) এদিক থেকেই ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে, তারপর এদিক ওদিক সবদিক থেকেই গুলি ছুঁড়তে থাকে, জানালার উপর।

ডেভিড ফ্রস্টঃ এসব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল, আমি আমার পরিবার-পরিজন এখানেই ছিলাম, ৬ বছরের ছোট ছেলেটি বিছানায় শোয়া ছিল, আমার স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।

ডেভিড ফ্রস্টঃ পাকিস্তান বাহিনী কোনদিক দিয়ে ঢুকেছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ সব দিক দিয়ে, ওরা এবার জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে সন্তান দুটিকে নিয়ে বসে থাকতে বলি, তারপর সেখান থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনার স্ত্রী সেসময় কিছু বলেছিলেন?

বঙ্গবন্ধুঃ না, তখন কোনো শব্দ উচ্চারণের অবস্থা ছিল না, আমি তাকে শুধু বিদায় সম্বোধন জানিয়েছিলাম। দরজা খুলে বাইরে এসে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম, তোমরা গুলি বন্ধ করো। আমি তো এখানেই দাঁড়িয়ে আছি, গুলি করছো কেন? তোমরা কী চাও? তখন চারদিক থেকে ওরা বেয়োনেট উঁচিয়ে ছুটে এলো, এক অফিসার আমাকে ধরে বলল: এই, ওকে মেরে ফেলো না।

ডেভিড ফ্রস্টঃ একজন অফিসারই ওদের থামিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, ঐ অফিসারই ওদের থামিয়েছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামাল, পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে, বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মারতে লাগল, অফিসারটা আমাকে ধরে রেখেছিল, তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে, টেনে নামাতে লাগল। আমি বললামঃ তোমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তো যাচ্ছি। বললাম, আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও। ওরা থামল। আমি উপরে যেয়ে তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম; আমার স্ত্রী তখন ছেলে দুটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে কিছু কাপড়-চোপড়সহ ছোট একটি সুটকেস ধরিয়ে দিলে সেটা নিয়ে নেমে এলাম। চারদিকে দেখলাম আগুন জ্বলছে। আজ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক এখান থেকে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে গেলো।

ডেভিড ফ্রস্টঃ সেদিন যখন ৩২ নাম্বারের আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন তখন কি ভেবেছিলেন আর কোনদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?

বঙ্গবন্ধুঃ না, আমি সেটা কল্পনাও করিনি, মনে মনে ভেবেছি, এই আমার শেষ। আর আজ যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি আত্মসমর্পণ করলে আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, সেটাও ভালো, তবু আমার দেশবাসীর মর্যাদার যেন কোনো হানি না ঘটে।

ডেভিড ফ্রস্ট

ডেভিড ফ্রস্টঃ শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেনযে মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পারো না কথাটা কি এমন ছিল না?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন, সেটা তার দেহ, কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, কেউ তা পারে না। এটা আমার বিশ্বাস। আমি মুসলমান, মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দুবার নয়। আমি মানুষ, আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কোনো দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছু তাদের দেবার অঙ্গীকার করেছি, আজ তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।

ডেভিড ফ্রস্টঃ পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, সবকিছুই ওরা লুট করেছে, বিছানা পত্র, আলমারি, কাপড় চোপড় সবকিছুই লুট করেছে। মিঃ ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন এ বাড়ির কোনো কিছুই আজ নেই।
ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব লুট হয়েছে না পাকিস্তানীরা করেছে?

বঙ্গবন্ধুঃ পাকিস্তানি ফৌজ সবকিছুই লুট করেছে। কিন্তু, এই বর্বর বাহিনী আমার আসবাব-পত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য সামগ্রী লুট করেছে তাতে আমার দুঃখ নেই, আমার দুঃখ ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুন্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল, একটা সুন্দর লাইব্রেরি ছিল, বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর এই মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সব কিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আবার তাই একই প্রশ্ন চলে আসে, কেন ওরা লুটতরাজ চালিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ এর কী জবাব দেওয়া যায়? ওরা তো মানুষ নয়, কতগুলো ঠগ, দস্যূ, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন, তা নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, দুই বছর, পাঁচ বছরের শিশু, মেয়েরা, কেউ রেহাই পেলো না, সব নিরীহ মানুষদের ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে জ্বালিয়ে দেয়া পোড়া বাড়ি, বস্তি দেখিয়েছি, একেবারে গরিব খেটে খাওয়া মানুষের বাস ছিল এখানে, এসব মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে, আর, ওরা চারদিক থেকে ঘেরাও করে মেশিনগান চালিয়েছে। ভুট্টো সেসময় বলেছিল, মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি তাহলে, একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে পারবে না। এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে, তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক। ভুট্টো আমাকে একথা জানিয়েছিল, ভুট্টোর নিকট আমি অবশ্যই এই জন্য কৃতজ্ঞ।

ডেভিড ফ্রস্টঃ শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সাথে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে তাহলে তাকে আপনি কী বলবেন?

বঙ্গবন্ধুঃ ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনী, তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই, তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধু

ডেভিড ফ্রস্টঃ ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দী রেখেছে, তাকে নিয়ে ভুট্টো এখন কী করতে পারে? আপনার ধারণা কী?

বঙ্গবন্ধুঃ মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি জানেন আমার বাংলাদেশে কী ঘটছে। শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং লুটপাট চালিয়েছে। খাদ্যের গুদামগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কথা সঠিক জানেন?

বঙ্গবন্ধুঃ এখনো আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি, আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে, সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড তো নিরর্থক, মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, ওরা কাদের হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে, গ্রামের মানুষকে, যে মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়ত শোনেনি, সেই গ্রামে পাখি মারার মতো গুলি করে পাকিস্তানিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আমার মনেও প্রশ্ন, আহ্কেন এমন হলো?

বঙ্গবন্ধুঃ না, আমিও জানি না, আমিও বুঝি না, পৃথিবীতে এমন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

ডেভিড ফ্রস্টঃ এটা তো মুসলমানের হাতেই মুসলমান হত্যা ছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ ওরা নিজেদের মুসলমান বলে। অথচ হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি, আমাদের ত্রাণ শিবিরে এখনও অনেকেই আছে, এদের স্বামী, পিতা সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, পুত্রের সামনে মাকে। আপনি চিন্তা করুন? আমি একথা কল্পনা করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না, এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কীভাবে? এরা তো পশুরও নীচে। মনে করুন আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষপর্যায়ের নেতা ছিলেন তিনি, সরকারের একজন প্রাক্তন মন্ত্রীও ছিলেন, তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তাঁর উপর নির্যাতন চলেছে, প্রথমে তাঁর এক হাত কেটেছে, তারপর আরেকটা, এরপর কেটেছে কান, তার পা কেটেছে, ২৪ দিন ব্যাপী তারঁ উপর নির্যাতন চলেছে (এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু কেঁদে দেন)। কিন্তু এটা একটা মাত্র ঘটনা নয়, আমাদের কত নেতা আর কর্মী, বুদ্ধিজীবী আর সরকারি কর্মচারীকে জেলখানায় আটক করে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী আমি ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু, একটা বাঘও তো মানুষকে হত্যা করলে এমন ভাবে করে না।

১৯৭১ সালে পাক বাহিনী কর্তৃক বাঙ্গালিদের উপর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ

ডেভিড ফ্রস্টঃ ওরা আসলে কী চেয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ ওরা চেয়েছিল আমাদের বাংলাদেশকে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনি তো জানেন মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙালি পুলিশ, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, যুবক, ছাত্র সবাইকে হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আমি শুনেছি যুদ্ধের শেষ দিকেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, আত্মসমর্পণের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৩০ নয়, ৩০০ জনকে ওরা হত্যা করেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে ঘরে আটকে রেখেছে, এরপর বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে খুঁজে বের করে হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ তার মানে, কারফিউ জারি করে সকল ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে এসকল হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, তাই করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ শেখ সাহেব, আপনার কি মনে হয় ইয়াহিয়া দুর্বল চরিত্রের লোক যাকে অন্যরা খারাপ করেছে না সে নিজেই একটা খারাপ লোক?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি মনে করি সে একটা নরাধম। ও একটা সাংঘাতিক মানুষ। ইয়াহিয়া যখন প্রেসিডেন্ট, তখন আমার জনসাধারণের নেতা হিসাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনার সময়ই তা দেখেছি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আমাদের আজকের এই আলাপে আপনি নেতা এবং নেতৃত্বের কথা তুলেছেন, আপনার কাছে যথার্থ নেতৃত্বের সংজ্ঞা কী?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি বলব একটি সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথার্থ নেতৃত্ব তৈরি হয়, কেউ হঠাৎ একদিনে নেতা হতে পারে না, তাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে, মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে, তার আদর্শ থাকতে হবে, নীতি থাকতে হবে। এই সব গুণ যার ভেতর থাকে সেই কেবল নেতা হতে পারে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ ইতিহাসের কোন নেতাদের আপনি স্মরণ করেন, প্রশংসা করেন?

বঙ্গবন্ধুঃ স্মরণীয় অনেকেই, বর্তমানের কারো কথা বলছি না।

ডেভিড ফ্রস্টঃ না, বর্তমানের কেউ নয়, কিন্তু ইতিহাসের কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করি। স্মরণ করি মাও সে তুং, লেনিন, চার্চিলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডিকেও আমি শ্রদ্ধা করতাম।

কিউবার মরহুম রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে বঙ্গবন্ধু

ডেভিড ফ্রস্টঃ মহাত্মা গান্ধী?

বঙ্গবন্ধুঃ মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ বসু, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্ক এদের জন্য আমার মনে গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা ডঃ সুকর্ণকে শ্রদ্ধা করতাম। এরা সবাই তো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছিলেন।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আজ এই মুহূর্তে, অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি কোন দিনটিকে আপনার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন বলে মনে করেন? কোন মুহূর্তটি আপনাকে সবচাইতে সুখী করেছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ যেদিন শুনলাম আমার বাংলাদেশ স্বাধীন, সেই দিনটিই ছিল সবচাইতে সুখের।

ডেভিড ফ্রস্টঃ এই দিনের স্বপ্ন কবে থেকে দেখতে শুরু করেন?

বঙ্গবন্ধুঃ অনেকদিন যাবৎ আমি এই স্বপ্ন দেখে এসেছি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ স্বাধীনতার সংগ্রামে আপনি কবে প্রথম কারাগারে যান?

বঙ্গবন্ধুঃ জেল গমণ শুরু হয় সম্ভবত ১৯৪৮ সালে। এরপর ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার হয়ে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। ১৯৫৪ সালে মন্ত্রী হই আবার ১৯৫৪তেই গ্রেফতার হয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠায়, তখন পাঁচ বছর আটক থাকি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ নানা মামলায় সরকার আমার বিচার করেছে। ১৯৬৬ সালে আবার আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিন বছর আটক রাখা হয়। এরপর ইয়াহিয়া খান গ্রেফতার করে। এমন দীর্ঘ সংগ্রাম শুধু আমার নয়, আমার বহু সহকর্মীর জীবনে একই ইতিহাস।

ডেভিড ফ্রস্টঃ মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, পৃথিবীর মানুষের জন্য আপনার কাছ থেকে কোনো বাণী আমি বহন করে নিয়ে যেতে পারি?

বঙ্গবন্ধুঃ আমার একমাত্র প্রার্থনা, বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য দেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়াক। আমার দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে তেমন আত্মত্যাগ খুব কম দেশের মানুষকেই করতে হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনাকে আমি আমার একজন বন্ধু বলে গণ্য করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি এদেশে আসুন, নিজের চোখে দেখুন, আপনি নিজের চোখে অনেক কিছুই দেখেছেন, আরো দেখুন। আপনি এই বাণী বহন করুন যে সকলের জন্যই আমার শুভেচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে বিশ্ব এসে দাঁড়াবে। আপনি আমার দেশের বন্ধু, আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। জয়বাংলা।

ডেভিড ফ্রস্টঃ জয়বাংলা আমিও বিশ্বাস করি, বিশ্ববাসী আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, আপনার পাশে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে নয়তো ঈশ্বর আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবেন না

 

উৎসঃ

http://www.sachalayatan.com/mustafiz/30840

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *