প্রচন্ড শীতের রাত। একটি মেয়ে ঘুমিয়ে অাছে তার বিছানায়। ঘুমিয়ে অাছে বললে ভুল হবে, শুয়ে অাছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় মেয়েটির ঘুম অাসছে না।
মেয়েটি উঠে পাশের কক্ষে গেল। সেখানে ঘুমিয়ে অাছেন তার বাবা। বাবাকে জাগিয়ে সে বললো নিজের সমস্যার কথা। মেয়েটির বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতো রাতে ফায়ারপ্লেসের জন্য কাঠ পাবেন কোথায়! তবুও তিনি মেয়েকে অাশস্ত করলেন যে খুব তাড়াতাড়িই তিনি কিছু একটা করবেন।
মেয়েটি নিজের কক্ষে এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। একটু পর সে খেয়াল করলো তার ঘরটি ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে। মেয়েটি অবাক হলো। বাবা এতো তাড়াতাড়ি কাঠ জোগাড় করে ফেলেছেন! সে কম্বলের ফাঁক দিয়ে ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকালো। তার অাশ্চর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো, যখন সে দেখলো ফায়ারপ্লেসে কাঠের পরিবর্তে পুড়ছে মার্কিন একশত ডলারের কয়েকটা বান্ডিল!
এটি কোনো হলিউড মুভির কাহিনী নয়। নয় কোনো অাষাঢ়ে কেচ্ছাও। মেয়েকে উষ্ণ রাখার জন্য মিলিয়ন ডলার পুড়িয়ে ফেলতে কার্পন্য বোধ করেননি যিনি, তিনি অার কেউ নন, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত কলম্বিয়ার কিংবদন্তী “ড্রাগ লর্ড” পাবলো এস্কোবার।
জন্ম ও শৈশবকাল
পাবলো এস্কোবার এর পুরো নাম পাবলো এমিলিও এস্কোবার গাভিরিয়া। জন্ম ১৯৪৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর কলম্বিয়ার রিওনেগ্রোর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। জন্মের পরপরই পরিবারের সাথে এস্কোবার পাড়ি জমান এনভিগাডোর মেডেলিন নামক শহরতলীতে। এস্কোবারের বাবা ছিলেন কৃষক এবং মা স্কুল শিক্ষিকা।
বাবা-মা’র অার্থিক অসচ্ছলতার কারণে ছোটকাল থেকেই এস্কোবারকে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেড়ে উঠতে হয়। ফলে কৈশোরে পা দেওয়া মাত্রই তার ভেতর দেখা দেয় অপরাধ প্রবণতা। কবরস্থান থেকে সমাধিপ্রস্তর চুরির মাধ্যমে অপরাধজগতে তার হাতেখড়ি হয়। তিনি তার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত লোকজনকে প্রায়ই বলতেন, ” দেখে নিও, আমি একদিন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হবো”।
উত্থান ও রাজত্ব
সত্তরের দশকে কলম্বিয়ায় জমজমাট হয়ে ওঠে কোকেইন ব্যবসা। এই সুযোগে এস্কোবার বলিভিয়া ও পেরু থেকে কোকা পাউডার কিনে সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে আমেরিকাতে বিক্রির জন্য পাচার করতে শুরু করেন।
১৯৭৫ সালের দিকে স্থানীয় মেডেলিন ড্রাগ লর্ড ফ্যাবিয়ো রেস্ট্রেপো খুন হন। এই খুনের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন এস্কোবারই। রেস্ট্রেপোর মৃত্যুর পর, এস্কোবার হয়ে উঠেন পুরো মেডেলিনের মাদকদ্রব্য সাম্রাজ্যের সম্রাট। আর কিছুদিনের মধ্যেই, মেডেলিন কার্টেল আমেরিকাতে পাচারকৃত কোকেইনের শতকরা আশি ভাগের যোগানদাতায় পরিণত হয়।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে এস্কোবারের মাথায় রাজনীতির ভূত চেপে বসে। অনেক তো অর্থসম্পদ হলো, এবার না হয় একটু ক্ষমতার স্বাদও আচ্ছাদন করা যাক। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের একটি আসন লাভ করেন তিনি। যদিও এই আসন পেতে যতটুকু কষ্ট হয়েছিলো, তারথেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট হয়েছিলো সেই আসন রক্ষা করতে গিয়ে।
অাক্রোশ ও জিঘাংসা
পাবলো এস্কোবার শৈশব থেকেই দুরন্ত ও দুর্বার ছিলেন। নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবার পর তিনি হয়ে ওঠেন অারো প্রতিশোধপরায়ণ।
তার জিঘাংসার প্রথম শিকার হন তৎকালীন আইনমন্ত্রী রড্রিগো লারা বনিলা। সেই সময় এস্কোবার চালু করেন এক অঘোষিত ধারা, ”প্লাটা ও প্লমো” যার ইংরেজি হলো, “সিলভার অথবা লেড”। যার অর্থ ছিলো, “ঘুষ (সিলভার) নাও, অথবা গুলি (লেড) খাও”। যারাই তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতো, তিনি তাদের ও তাদের পরিবারকে ধ্বংস করে ছাড়তেন।
কথিত আছে, একবার তিনি গেরিলাবাহিনী এম-১৯ কে দিয়ে কলম্বিয়ান সুপ্রিম কোর্ট ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এছাড়াও তার আদেশে ১৯৮৯ সালের ২৭ নভেম্বর আত্মঘাতী বোমার সাহায্যে ২০৩ জন যাত্রীবাহী একটি বিমান ভূপাতিত করে দেওয়া হয়।
ব্যক্তিজীবন ও প্রাচূর্য্য
বিশ্বব্যাপী অাতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করলেও পরিবার ও কাছের মানুষদের কাছে এস্কোবার ছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র। ১৯৭৫ সালে ১৬ বছর বয়সী মারিয়া ভিক্টোরিয়া হেনাও ভেলেজোকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের সংসার আলোকিত করে আসে হুয়ান পাবলো ও ম্যানুয়েলা নামক দুই সন্তান। পাবলোর কাছে তার নিজের জীবন ও ক্ষমতার পর যদি কিছু প্রিয় থেকে থাকে, তাহলে সেটি ছিলো তার পরিবার।
“কিং অব কোকেইন” নামে পরিচিত এই চোরাকারবারী শুধু বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশীল ব্যক্তিই ছিলেন না, ছিলেন অবিশ্বাস্য সম্পদের মালিকও। ধারণা করা হয়, তিনি প্রায় ৭০০০ একর জমিজমা এবং ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক ছিলেন।
কলম্বিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন একদম নিজেদের পাড়ার ছেলের মতনই অাপন। তারা তাকে রবিনহুড নামে আখ্যায়িত করতো। তিনি মেডেলিনে সামাজিক কল্যাণমুখী কাজ করেছিলেন। তিনি লাখ লাখ ডলার তার এলাকাতে পার্ক, স্কুল,স্টেডিয়াম, গীর্জা, এমনকি অসহায় দুস্থদের বাড়ি নির্মাণে খরচ করেছিলেন।
অাইনের সাথে লুকোচুরি
১৯৭৬ সালে ইকুয়েডর থেকে মাদকদ্রব্য পাচার থেকে আনার সময় পুলিশের হাতে প্রথম গ্রেফতার হন পাবলো এস্কোবার। কিন্তু তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে খুন করে কারগার থেকে ছাড়া পেয়ে যান তিনি।। এরপর বেশ কয়েক বছর তাঁকে ধরার অনেক চেষ্টা করা হলেও, কোনোভাবেই তা সম্ভব হচ্ছিলো না। এর কারণ ছিলো এস্কোবার কখনো নিজের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ রাখতেন না। হোক দলিল-দস্তাবেজ অথবা জলজ্যান্ত মানুষ, প্রমাণ সম্পূর্নরূপে ধ্বংস না করা অব্দি তিনি ক্ষান্ত হতেন না।
এস্কোবারকে মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দেয়ার জন্য কলম্বিয়ান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু এস্কোবারের বক্তব্য ছিলো, ”আমেরিকার কারাগার থেকে কলম্বিয়ার কবর অনেক গুণে ভালো”। অবশেষে কলম্বিয়ান সরকার ও এস্কোবারের সম্মতিতে এস্কোবারকে কলম্বিয়ার একটি বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। নামে কারাগার হলেও অাসলে সেটি ছিলো একটি বিশাল আলিশান ভবন, যাতে ঝর্ণা থেকে শুরু করে খেলার মাঠের মতো সকল সুযোগ সুবিধাই ছিলো।
“লা ক্যাটেড্রেল” নামক সেই কারাগার হয়ে ওঠে এস্কোবারের দ্বিতীয় হেডকোয়ার্টার। তাই ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে কলম্বিয়ান সরকার বাধ্য হয়ে মিলিটারি বাহিনী পাঠায়, তাকে ধরে এনে সাধারণ জেলে পুরে রাখার জন্য। কিন্তু তিনি সেখান থেকে পালিয়ে গা ঢাকা দেন।
চুড়ান্ত পতন
প্রায় দেড় বছর পর ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ কলম্বিয়ান সিকিউরিটি ফোর্স মেডেলিনের একটি সাধারণ কলোনিতে এস্কোবারের অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এস্কোবারকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে দলবল নিয়ে অভিযানে নেমে পড়ে তারা। এস্কোবার তার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান পালিয়ে যাবার। ছাদ থেকে পালিয়ে যাবার সময় কানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
অনেকে মনে করেন, কলম্বিয়ান পুলিশ তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছিলো। এভাবেই ১৯৯২ সালের ২ ডিসেম্বর পতন ঘটে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম এক খলনায়কের।