ধরুন অাপনি একজন উঠতি লেখিকা, সবে কিছুদিন হলো লেখালেখি শুরু করেছেন। দু-একজন অাপনার লেখার প্রশংসা করলেও খুব একটা সাড়া পাচ্ছেন না। এদিকে অাপনার অর্থনৈতিক অবস্থাটাও এমন যে কিছু দিন পরপরই সংসার চালানোর জন্য হাত পাততে হচ্ছে অাত্মীয় স্বজনের কাছে।
এমনই এক কারণে অাপনাকে যেতে হচ্ছে পাশের এক শহরে। উদ্দেশ্য, এক অাত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়া। অাপনি স্টেশনে বসে অাছেন, কখন ট্রেন অাসে সেই প্রতীক্ষায়। একপর্যায়ে ট্রেন চলে এলো। অাপনি ট্রেনে উঠে পড়লেন। চারিদিকে যাত্রীদের প্রচন্ড কোলাহল, ভিড়-বাট্টা, চেঁচামেচি। অাপনি প্রতিদিনই এগুলো দেখে অভ্যস্ত, তবুও অাপনার মন বিরক্তিতে ভরে গেলো। একে তো ধার পাবেন কিনা সেই দুুশ্চিন্তা, তারপর সময়মতো গন্তব্যে পৌছাতে পারবেন কিনা সেই চিন্তাও চেপে বসলো মাথায়।
নিজের চিন্তার মোড় ঘোরাতে অাপনি সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করলেন। হঠাৎ করেই অাপনার কল্পনার জগতে উঁকি দিল মা-বাবা হারানো এক কিশোরের কথা। যে বাস করে তার ফুফু ও ফুপার বাড়িতে। যারা দুজনই খুব নীচুমনের অধিকারী। মজার ব্যাপার হলো, ছেলেটি শত অন্যায় অত্যাচার সহ্য করলেও সে জানে না যে, তার মধ্যে রয়েছে এক মায়াবী জাদুকরী ক্ষমতা।
ব্যাস অার যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে অাপনি নিজের মনের ক্যানভাসে একে ফেললেন সেই অসহায় কিশোরের মুখাবয়ব। বাড়ি ফিরে এসে বসে গেলেন লিখতে। একপর্যায়ে শেষ হলো লেখা, প্রকাশিত হলো বই। অাপনি অবাক হয়ে দেখলেন, অাপনার বইটি পুরো পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত হচ্ছে! ৬৪ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে সেই বই, বিক্রি হয়েছে ৩২৫ মিলিয়ন কপি।
অনেকে হয়তো এ পর্যন্ত পড়ে ভাবছেন, এটা নির্ঘাত কোনো রূপকথার গল্প বা হলিউড মুভির কাহিনী। না, এটা কোনো গল্প কিংবা কাহিনী নয়, নিখাদ বাস্তব। অার যার কথা বলছি তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রাউলিং।
১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই ইংল্যান্ডের গ্লুসেস্টারশায়ারের ইয়েটে জন্ম নেন জোয়ান ক্যাথলিন রাউলিং। পরিবারে ছিলেন বাবা, মা অার ছোট্ট বোন। ছোটবেলায় আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো খেলাধুলার প্রতি তেমন ঝোঁক ছিল না রাউলিংয়ের। ভারি লাজুক ধরনের মেয়ে ছিলেন তিনি, চুপচাপ বসে বসে পড়তেই বেশি ভালোবাসতেন। ছোট বোনের আবদার মেটাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে মুখে মুখে গল্প বানাতে শুরু করেন তিনি।
বড় হয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। জীবিকার সন্ধানে চলে যান লন্ডন। সেখানে গিয়ে সেক্রেটারি হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন, সেক্রেটারি হওয়া তাঁর কর্ম নয়। ইংল্যান্ড ছেড়ে পর্তুগালে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে পরিচয় হয় এক পর্তুগিজ সাংবাদিকের সাথে। কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করেন তাঁরা, সন্তানও হয় তাঁদের। কিন্তু মেয়ের জন্মের চার মাসের মাথাতেই রাউলিং ও তাঁর স্বামীর বিচ্ছেদ হয়। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাউলিং দেশে ফেরত আসেন।
শুরু হয় রাউলিংয়ের কষ্টের জীবন। সংসার ভেঙে গেছে, কোলে ছোট্ট মেয়ে, ঘরে কপর্দক পর্যন্ত নেই। সরকারি ভাতার ওপর নির্ভর করে মানবেতর জীবনযাপন শুরু করেন মা-মেয়ে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাউলিং। পরবর্তীতে সেই হতাশার দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন,
‘আমি আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম। শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে পেরে উঠিনি। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি নিজেকে সামলে নিই। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমার নিজের এই অবস্থা হলে মেয়েকে মানুষ করতে পারব না। অতঃপর নিজেকে শেষ করে দেওয়ার বদলে আমি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই, নয় মাস ধরে একজন কাউন্সিলরের কাছে চিকিৎসা নিতে হয় আমাকে।’
স্কটল্যান্ডের এডিনবরার এক ক্যাফেতে বসে তিনি একটু একটু করে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৯০ সালে জে কে রাউলিংয়ের মাথায় আসে ‘হ্যারিপটার’ গল্পের ধারণা। লোকজনে ভর্তি এক পাতাল ট্রেনে চড়ে ম্যানচেষ্টার থেকে লন্ডন যাচ্ছিলেন রাউলিং। সেখানেই পেয়ে যান তার গল্পের প্লট। এক ছোট্ট ছেলের কাহিনি, যে ট্রেনে চড়ে জাদুকরদের এক স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছে। সেই ছেলে আর কেউ নয়, হ্যারি পটার।
একই সঙ্গে হ্যারির চেহারাটাও ভেসে ওঠে তার মানসপটে। এ অভিজ্ঞতাটি লেখিকা রাউলিং বর্ণনা করেছেন এভাবে –
“খুব ছোটবেলা থেকে লিখলেও এই আইডিয়াটির মতো কোনো ব্যাপারে আমি এতো উত্তেজিত হইনি। ট্রেন ভ্রমণের প্রায় চার ঘণ্টা বসে আমি পুরো বিষয়টি নিয়ে ভাবলাম। মনের চোখে দেখতে পেলাম মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত কালো চুলের হ্যারিকে; যে জানে না সে বিষ্ময়কর জাদুকরি ক্ষমতাধর একটি ছেলে।”
১৯৯৫ সালে রাউলিং হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার’স স্টোন বইটি লেখা শেষ করেন আর কয়েকজন এজেন্টকে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠান। মজার বিষয় হলো, শুরুতে কেউই বইটি ছাপতে রাজি হয়নি। আটজন প্রকাশকের প্রত্যাখানের পর ব্লুমসবারি নামের একটি প্রকাশনী ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন হ্যারিপটার সিরিজের প্রথম বই ‘হ্যারিপটার এ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন’ প্রকাশ করে। তা-ও সম্ভব হয় সেই প্রকাশকের আট বছর বয়সী মেয়ের কারণে, যে বইটি দারুণ পছন্দ করেছিল। বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অগ্রিম সম্মানী হিসেবে রাউলিংকে দেড় হাজার পাউন্ড দেওয়া হয়।
হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো একের পর এক সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে সব রেকর্ড ভেঙে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার বইটি প্রকাশ হওয়ার প্রথম দিনেই যুক্তরাজ্যে বিক্রি হয় প্রায় তিন লাখ কপি, আর দুদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয় ৩০ লাখ কপিরও বেশি।
এপর্যন্ত হ্যারি পটার সিরিজের সাতটি বইয়ের প্রথম ৬টি বই সারা পৃথিবীতে ৩২৫ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে এবং ৬৪টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও ‘হ্যারিপটার’ উপন্যাস অবলম্বনে ৭টি মুভি নির্মাণ করা হয়েছে। বইয়ের মতো রূপালি পর্দায়ও সমানভাবে জনপ্রিয়তা পায় এই মুভি সিরিজের প্রতিটি মুভি। ১৯৯৮ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে রাউলিং তাঁর প্রথম দুটি বইয়ের চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বত্ব বিক্রি করে দেন। এরপর আর কখনো অর্থাভাবে পড়তে হয়নি তাঁকে।
এক সময়ে তার নাম উঠে আসে বিশ্বের শীর্ষ ধনী নারীর তালিকায়। ২০০৪ সালে ফোর্বস পত্রিকা তার সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করে। এ বিরল অর্জন রাউলিংকে বই লিখে ধনী হওয়া প্রথম বিলিয়নিয়ার নারী হওয়ার মর্যাদা দান করে। ২০০৬ সালে ফোর্বস পত্রিকা তাকে অপরাহ উইনফ্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী নারী বলে অভিহিত করে। ২০০৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাবে বিশ্বের ক্ষমতাবান সেলিব্রেটিদের তালিকায় জে কে রাউলিং ছিলেন ৪৮তম। ২০০৭ সালে টাইম ম্যাগাজিন রাউলিংকে ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ রানার-আপ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১১ সালে ব্রিটেনের ন্যাশনাল ম্যাগাজিন রাউলিংকে ব্রিটেনের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী হিসেবে নির্বাচিত করে।
জে কে রাউলিং তার লেখক জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চারবার হুইটেকার প্লাটিনাম বুক এ্যাওয়ার্ডস, তিনবার নেসলে স্মার্টিস বুক প্রাইজ, দুবার স্কটিশ আর্টস কাউন্সিল বুক এ্যাওয়ার্ডস, উদ্বোধনী হুইটব্রেড বর্ষসেরা শিশুতোষ গ্রন্থ পুরস্কার, ডব্লিউ এইচ স্মিথ বর্ষসেরা বই। ২০০০ সালে ‘হ্যারিপটার এ্যান্ড দ্য প্রজনার অব আজকাবান’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বিভাগে ‘হিউগো’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তবে ২০০১ সালে ‘হ্যারিপটার এ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার’ বইটি ওই পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়।
সাফল্যের শিখরে উঠলেও নিজের অতীত ভুলে যাননি রাউলিং। ২০০০ সালে তিনি একটি দাতব্য ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন, যা দুস্থ নারী ও শিশুদের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ পাউন্ডের মতো সহায়তা প্রদান করে থাকে।