কথায় অাছে, মুখ দেখে কখনো মানুষ অান্দাজ করতে নেই। কখনো কখনো সুন্দর চেহারার অাড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে কদর্য মানসিকতা এবং ভয়ংকর নির্মমতা। তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ বনি পার্কার ও ক্লাইড ব্যারো জুটি। চিত্রের এই সুদর্শন দম্পতি কে দেখে অনেকেরই ঈর্ষাকাতর হওয়ার কথা। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি বলা হয়, এই দম্পতি অপরাধ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এক খুনে দম্পতি হিসেবে, তাহলে হয়তো অনেকেরই চক্ষু ছানাবড়া হবার দশা হবে।
সুদৰ্শন ক্লাইডের জন্ম ১৯০৯ সালের ২৪ মার্চ, টেক্সাস প্রদেশের একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে। শৈশব থেকেই তার নিষ্ঠুর মনোভাবের আভাস পাওয়া যায়। সে প্রায়ই নির্মমভাবে খামারের গবাদি পশুর উপর অত্যাচার চালাতো। এছাড়াও খেলার সাথীদের অাঘাত দেয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। অতিষ্ঠ হয়েই ক্লাইডের বাবা তাকে সিমেন্ট শহরে পাঠিয়ে দেন। তিনি আশা করেছিলেন, কষ্ট করে জীবনযাপন করতে গিয়ে ক্লাইডের স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন আসবে ।
বনির জন্ম ১৯১১ সালে এক যাজক পরিবারে। মাত্র চার বছর বয়সেই সে তার বাবাকে হারায়। অভাবের তাড়নায় তার মা তাকে নিয়ে টেক্সাস প্রদেশের সিমেন্ট শহরে এসে বসবাস শুরু করে। বনি ছিল অত্যন্ত সুন্দরী। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রয় থর্টন নামক এক ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হয়। তবে এই আকস্মিক বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। রয় প্রায়ই বিভিন্ন চুরি-ডাকাতি করত এবং নেশা ও জুয়ার পেছনে সব টাকা উড়াত। বিয়ের কিছুদিন পরই রয়কে খুনের দায়ে ৯৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলে বনির সংসার ভেঙে যায়। কয়েক বছর পর ক্লাইডের সাথে বনির পরিচয় হয় এবং তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। এসময় বনির বয়স ছিল উনিশ বছর এবং ক্লাইডের একুশ।
প্রথম যেদিন ক্লাইড বনির বাড়িতে নৈশভোজের দাওয়াতে যায়, সেদিনই সে গ্রেপ্তার হয়। ৭টি অভিযোগের আলোকে তাকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে পুরোপুরি দুই বছর কারাদণ্ড খাটতে হয়নি কারণ ক্লাইড জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়। পালানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই সে একটি রেলওয়ে অফিসে ডাকাতি করে। এবারও সে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি। তাকে টেক্সাস কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ক্লাইড অন্য একজন কয়েদিকে প্ররোচিত করে নিজেকে অাহত করে। কারাগার কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসা করায় এবং তাকে মুক্তি দেওয়া হয় ।
এরপর বনির মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ক্লাইড ম্যাসাচুসেটস শহরে একটি সাধারণ চাকরি নেয়। কিন্তু সৎ জীবন তার সহ্য হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত চাকুরি ছেড়ে সে পশ্চিম ডালাসে চলে আসে। এর তিনদিন পরই বনি তার মায়ের বাড়ি ছেড়ে ডালাসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেখানে এই দম্পতির সাথে যোগ দেয় ক্লাইভের পুরনো বন্ধু রে, রিকি ও জোনস।
পাচজনের এই সংঘবদ্ধ দলটি তাদের প্রথম খুনটি করে ১৯৩২ সালে টেক্সাসের হিলসবরোতে। জন ডব্লিউ বুচার নামক একজন স্বর্ণকারকে মাত্র চল্লিশ ডলারের জন্য নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। ওই সময় বনি একটি গাড়ি চুরির অভিযোগে কারাগারে ছিল। তিন মাস পরই সে ছাড়া পেয়ে যায়।
তাদের সবচেয়ে বড় অংকের ডাকাতি ছিল গ্র্যান্ড প্রেইরির একটি ফিলিং স্টেশনে। সাড়ে তিন হাজার ডলারের। জঘন্য এই চক্রটির সবচেয়ে ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য ছিল যে তারা খুবই ক্ষুদ্র অংকের টাকার জন্য অবলীলায় খুন করত। তারা টেক্সাসে একজন কসাইকে হত্যা করে ও তার দোকান লুটপাট করে। এর কিছুদিন বাদে উইলিয়াম জোনস নামক একটি ছেলে তাদের হাতে প্রাণ হারায়। সে ‘ব্যারো শ্যাং’ শীৰ্ষক গানের দলের গিটারিস্ট ছিল এবং তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
১৯৩৩ সালের মার্চে চক্রটি আবার মিসৌরিতে ফিরে যায়। সেখানে তাদের সাথে যোগ দেয় ক্লাইডের ছোট ভাই বাক এবং তার স্ত্রী ব্লানচে। তারা দুজনেই ছিল ভয়ংকর অপরাধী। বাক ও তার স্ত্রীর অন্তর্ভুক্তির পর দলটি আরও ভয়ংকর ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
জুন মাসে টেক্সাসের ওয়েলিংটন শহরের কাছে একটি গ্রামে তাদের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরু খাদে পড়ে যায়। ক্লাইড গাড়ি থেকে বেরিয়ে অাসতে পারলেও বনি অাটকা পড়ে যায়। একপর্যায়ে গাড়িটিতে আগুন ধরে যায় এবং বনির শরীরের অনেকখানি পুড়ে যায়। এ অবস্থায় স্থানীয় একজন কৃষক তাদের উদ্ধার করে। কৃষকটি দয়ালু হয়ে তাদেরকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। কিছুদিন পর তাদের কথাবার্তায় কৃষকটির সন্দেহ হয় ও সে পুলিশকে ব্যাপারটা জানায়। তবে ভাগ্য তাদের সাথেই ছিল বলতে হবে। কারণ এবারও তারা আশ্চর্যজনকভবে পুলিশকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে যায়।
১৯৩৪ সালের ২ মে’র এক সকালে বনি ও ক্লাইডের প্রিয় ফোর্ড ভি-৮ সেডান গাড়িতে আতর্কিত হামলা চালায় ছয়জন দক্ষ পুলিশ অফিসার। কিছু বুঝে উঠার আগেই ৮৭ টি বুলেটের আঘাতে ঝাঝরা হয়ে যায় তাদের গাড়িটি। তৎক্ষণাতই তারা মৃত্যুবরণ করে এবং সেখানেই ইতি হয় বনি ও ক্লাইডের প্রেমকাহিনির। এই প্রেমিক জুটির জীবনের শেষ দিনে ক্লাইডের বয়স ছিল ২৫ বছর এবং বনির বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর।
বনি ও ক্লাইড দুজনে তাদের পিতা মাতাকে অনেক ভালোবাসত এবং তাদের সবচেয়ে বড় আফসোস ছিল এটাই যে তারা হয়তো মৃত্যুর আগে আর কোনোদিন তাদের দেখতে পারবে না। শুধু তাই নয়, বনি তাদের মৃত্যু ও শেষজীবন কেমন হতে পারে চিন্তা করে ‘দ্য স্টোরি অব বনি এন্ড ক্লাইড’ (The Story of Bonnie and Clyde) শীর্ষক একটি কবিতাও লিখেছিল।
বনি ও ক্লাইডের কার্যকলাপের কাহিনী শুনলে এখনো গা শিউরে ওঠে অনেকের। কিন্তু অনেকেই আবার তাদের আদর্শ প্রেমিক জুটি হিসেবে মনে রেখেছে। নিষ্ঠুরতা ও ঘৃণার মাঝেও এই প্রেমকাহিনি তাদেরকে অমর করে রেখেছে।