আমির খান পরিচালিত ও অভিনীত ‘তারে জামিন পার’ তো মনে হয় আপনারা সবাই দেখেছেন। ছবিটি ছিল ইশান নামের স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে। ইশানের বাবা-মা তাকে উপর বড্ড নারাজ ছিল। কারণ সে পড়ালেখায় খুবই কাঁচা। সে বার বার অভিযোগ করত যে সে বর্ণগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে যে তারা যেন বই থেকে বের হয় নাচছে। এসব কথাকে তার পড়াশুনা না করার অজুহাত মনে করে খারিজ করে দেয় তার বাবা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে আসলে ইশান এক রোগে ভুগছিল যার কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছিল। সেই রোগটির নাম হচ্ছে ডিসলেক্সিয়া।
ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) হল এক ধরনের মানসিক রোগ, যেখানে আক্রান্ত শিশুর পড়তে, লিখতে, কথা বুঝতে এবং উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়। ডিসলেক্সিয়া শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ হচ্ছে শব্দ শনাক্ত করতে অসুবিধা। জার্মান চক্ষু চিকিৎসক রুডলফ বার্লিন সর্বপ্রথম ডিস্লেক্সিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন। মূলত বিভিন্ন শব্দকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারাকে তিনি ডিসলেক্সিয়া বলে চিহ্নিত করেন।
ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশু একইরকম দেখতে বা শুনতে অক্ষর বা সংখ্যাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। যেমন (b,d); (m,w); (6,9)। নতুন কোনো শব্দের বানান বা অর্থ সে মনে রাখতে পারে না। ডিসলেক্সিক বাচ্চারা সাধারণত কোনো বিষয়ে তাদের মনোযোগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও তারা লেখাপড়ায়, খেলাধুলায় সমবয়সী অন্য শিশুদের থেকে পিছিয়ে থাকে।
ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্তের কারণঃ
জন্মগতভাবেই সাধারণত শিশুরা ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হয়। ডিসলেক্সিয়ার কারণ এখনো আমাদের কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। তা নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে। তবে গবেষকরা প্রাথমিকভাবে কিছু কারণ শনাক্ত করেছে।
- পূর্বে বংশের কারো ডিসলেক্সিয়া হয়ে থাকলে নবজাতকের ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- নয় মাসের আগেই যদি কোনো বাচ্চার জন্ম হওয়া অথবা জন্মের সময় ওজন কম থাকা।
- গর্ভাবস্থায় মায়ের মদ্যপান অথবা এমন কোনো মাদক গ্রহণ করা যা বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
- মস্তিষ্কের যে অংশ কথা বলা ও লেখাকে নিয়ন্ত্রন করে সেখানে কোনো আঘাত পড়লে।
ডিসলেক্সিয়া শনাক্তকরণঃ
স্কুলে যাওয়ার আগ থেকেই শিশু ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ করতে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স অনুসারে এসব লক্ষণ পরিবর্তিত হতে থাকে।
শিশুর স্কুলে যাওয়ার পূর্বেঃ
- অক্ষর ও শব্দ মনে রাখতে না পারা।
- অক্ষরের সাথে আওয়াজের সম্পর্ক ধরতে না পারা।
- কথা বলা শিখতে দেরি হওয়া।
- নতুন শব্দ শিখতে কষ্ট হওয়া।
- একইরকম শুনতে শব্দগুলোকে আলাদা করতে না পারা।
শিশুর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরঃ
- তথ্য মনে রাখতে না পারা।
- বাজে হাতের লেখা।
- পেনসিল বা কলম ধরতে সমস্যা হওয়া।
- ছড়া বা কবিতা মনে রাখতে না পারা
- একরকম দেখতে অক্ষরে তফাৎ না করতে পারা।
- একই বানান বারবার ভুল করা।
- কথা বলতে গিয়ে শব্দ মনে না করতে পারা।
- তাকে দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে না পারা।
- অঙ্ক করতে না পারা।
- নতুন ভাষা শিখতে সমস্যা।
- পড়াশোনা এড়িয়ে চলা।
কিশোর বয়সে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলেঃ
- জোর গলায় কিছু পড়তে সমস্যা হওয়া।
- রসবোধ, ধাঁধাঁ, বাগধারা ইত্যাদি বুঝতে না পারা।
- কবিতা বা গল্প পড়ে মনে রাখতে না পারা।
- উচ্চারণ ও বানানে ভুল করা।
- অঙ্ক করতে ভয় পাওয়া।
- সময়মত কাজ শেষ করতে সমস্যা হওয়া।
ডিসলেক্সিয়ার চিকিৎসাঃ
ডিসলেক্সিয়া থেকে নিরাময় পাওয়ার জন্য একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞেরা মিলে ডিসলেক্সিক শিশুকে বিকল্প উপায়ে শেখাতে পারেন। শিশুকে অডিও রেকর্ডারের সাহায্যে পড়ানো, ত্রিমাত্রিক অক্ষর ছুঁয়ে ও স্পর্শ করিয়ে অক্ষর চেনানো, ছবি দেখিয়ে নতুন শব্দ শেখানো ইত্যাদি কিছু ফলপ্রসু উপায়। ফোনেটিক্স (ধ্বনি) বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়েও শিশুকে সঠিক উচ্চারণ শেখানো যেতে পারে। ছোট ছোট লক্ষ্য তৈরি করে শিশুকে পড়তে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে।
ডিসলেক্সিয়া কোনো অনিরাময়যোগ্য রোগ নয়। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বাবা-মা, শিক্ষক ও আশেপাশের মানুষের একটু সহমর্মিতা, উৎসাহ ও সহযোগিতা পেলেই ডিসলেক্সিক শিশুরা এই ভয়াল রোগের কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারবে।