গতকাল ছিল জার্মানির জন্য এক দুঃস্বপ্নের দিন। ১৯৩৮ সালের পর প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে গিয়েছে জার্মানরা। তাদের এই পরাজয়ে স্তব্ধ বিশ্বের কোটি কোটি জার্মান সমর্থক। সোজা চোখে দেখলে এই বিদায়কে অঘটন বলে মনে হলেও অন্যভাবে দেখলে একে অনুমিত ফলও বলা যেতে পারে। কারণ জার্মানির আগে গত তিন ইউরোপিয়ান বিশ্বকাপ বিজেতারাও বিশ্বকাপ জয়ের পরবর্তী আসরেই প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পরে যায়। সেদিক থেকে দেখলে জার্মানি শুধু ইউরোপিয়ান দলগুলোর এই ব্যর্থতার ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
চলুন দেখে আসা যাক কিভাবে ইউরোপীয় বিশ্বকাপ বিজেতারা বারবার এই দুর্ভাগ্যের চক্রে বাধা পড়ে যাচ্ছেঃ
১.ফ্রান্সঃ
নিজ দেশে অনুষ্ঠিত ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ও ২০০০ সালে ইউরো বিজয়ী ফ্রান্সকে ছিল ২০০২ বিশ্বকাপে শিরোপার অন্যতম দাবিদার।
কিন্তু বিশ্বকাপের ১ম ম্যাচেই সেনেগালের কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় ফ্রান্স। কিন্তু তারপরও ফ্রেঞ্চরা ২য় রাউন্ডে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। কিন্তু নিজেদের ২য় ম্যাচে উরুগুয়ের সাথে 0-0 গোলে ড্র করলে তাদের জন্য ২য় রাউন্ডে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বকাপের আগেই ইনজুরিতে পরা জিদানকে তাই পুরোপুরি ফিট হওয়ার আগেই শেষ ম্যাচে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে মাঠে নামানো হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয় না। ডেনমার্কের বিপক্ষে ২-০ গোলে পরাজিত হয়ে একটি ম্যাচ না জিতে ও কোনো গোল না করে ফ্রান্স বিশ্বকাপের ১ম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয়।
২.ইতালিঃ
২০০৬ সালে ফ্রান্সকে পেনাল্টি শুটআউটে হারিয়ে চতুর্থবারের মত বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে ইতালি। ২০১০ সালের আসরে তরুণ খেলোয়াড়দের না নিয়ে আগের আসরের অভিজ্ঞদের উপরই আস্থা রাখেন কোচ লিপ্পি।
গ্রুপ পর্বের প্রথম দুটি ম্যাচে প্যারাগুয়ে ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে ইতালি। কিন্তু নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে খেলতে আসা স্লোভাকিয়ার কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় আজ্জুরিরা। এভাবে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি ম্যাচও না জিতে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পরে যায় ইতালি।
৩.স্পেনঃ
২০১০ সালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে এক্সট্রা টাইমে ইনিয়েস্তার গোলে স্পেন তাদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জয় করে। বিশ্বকাপের পাশাপাশি ২০০৮ ও ২০১২ সালে স্পেন ইউরোতেও চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৪ সালের আসরে স্পেন নিজেদের শিরোপা ধরে রাখার মিশনাই ব্রাজিলে পা রাখে।
কিন্তু নিজেদের প্রথম ম্যাচেই গত বিশ্বকাপের রানার্সআপ নেদারল্যান্ডের কাছে ৫-১ ব্যবধানে হেরে যায় স্পেন। শুরুর এই ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেনি স্পেন। পরের ম্যাচেই চিলির কাছে ২-০ গোলে হেরে গেলে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় স্পেনের। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ গোলে হারালেও সেই জয়টি ছিল সম্পূর্ণ মূল্যহীন। ব্রাজিল বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে বাদ পড়ার মাধ্যমে বিশ্ব ফুটবলের উপর স্পেনের শাসনেরও সমাপ্তি ঘটে।
৪.জার্মানিঃ
২০০২-২০১৪ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপেই সেমিফাইনাল খেলেছে জার্মানি। এর মধ্যে ২০০২ সালে ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ফাইনালে হেরে একবার রানার্সআপ হয় জার্মানরা। ২০০৬ ও ২০১০ সালে ইতালি ও স্পেনের কাছে সেমিফাইনালে হেরে যায় জার্মানি। কিন্তু ২০১৪তে এসে সেমিফাইনালে স্বাগতিক ব্রাজিলকে ৭-১ ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে এক্সট্রা টাইমের গোলে আর্জেন্টিনাকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে চতুর্থবারের মত শিরোপা ঘরে তোলে জার্মানি। ২০১৮ সালে শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসেবে রাশিয়ায় আসে জোয়াকিম লোর শিষ্যরা।
গ্রুপ পর্বে জার্মানির প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে মেক্সিকো, সুইডেন ও দক্ষিণ কোরিয়া। তাই গ্রুপ পর্ব থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে যাবে জার্মানি তা সবাই একপ্রকার ধরে রেখেছিল। কিন্তু বিধিবাম, প্রথম ম্যাচেই তারা ১-০ গোলে হেরে যায় মেক্সিকোর কাছে। তারপরের ম্যাচে শেষ মিনিটের গোলে ২-১ ব্যবধানে এক কষ্টার্জিত জয় পায় সুইডেনের বিপক্ষে। শেষ ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়া। এই ম্যাচে জয়ী হলেই পরের রাউন্ডে চলে যাবে জার্মানি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণকে ভাঙতে পারলো না জার্মানরা। উল্টো শেষ মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়া দুবার বল পাঠিয়ে দেয় জার্মানদের জালে। ২-০ গোলে হেরে যায় জার্মানরা দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে।
জার্মানির পরাজয়ের মাধ্যমে টানা চার ইউরোপীয় বিশ্বকাপজয়ী দল বিশ্বকাপ জয়ের পরের আসরেই ১ম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে গেল। এই ধারাবাহিকতা আর কতদিন টিকে থাকবে এখন সেটাই দেখার বিষয়।