রাশিয়া বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি আমরা। ইতিমধ্যেই গ্রুপ এ ও গ্রুপ বি-এর সব ম্যাচের সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু গ্রুপ পর্বের অন্য ম্যাচগুলোর মত সব ম্যাচ আলাদা সময়ে না হয়ে প্রতিটি গ্রুপের শেষ দুটি ম্যাচ একসাথে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আসলে যেন কোনো দল বিপক্ষ দলের পয়েন্ট তালিকায় সর্বশেষ অবস্থা জেনে ম্যাচ পাতাতে না পারে সেজন্যই এ নিয়ম। কিন্তু বিশ্বকাপের শুরু থেকে এ নিয়মটি চালু ছিল না। ১৯৮২ সালের স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কিত ম্যাচের কারণেই ফিফা এই নিয়ম সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়।
১৯৮২ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলার সুযোগ পায় আফ্রিকা মহাদেশের দল আলজেরিয়া। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই পরাক্রমশালী পশ্চিম জার্মানিকে ২-১ গোলে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেয় আলজেরিয়া। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে আস্ট্রিয়ার কাছে হেরে গেলেও পরের ম্যাচে তারা চিলির বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে জিতে পরের রাউন্ডে যাওয়া একপ্রকার নিশ্চিত করে ফেলে।
গ্রুপের শেষ ম্যাচ। পশ্চিম জার্মানি বনাম অস্ট্রিয়ার ম্যাচ। পরের রাউন্ডে ওঠার সমীকরণ আগে থেকেই জানা ছিলো দু’দলের। চিলির বিপক্ষে আলজেরিয়া জিতে যাওয়ায় গ্রুপ-দুই এর এই শেষ ম্যাচে দুই গোলের বড় ব্যবধানে অস্ট্রিয়া না হারলে পশ্চিম জার্মানি আর অস্ট্রিয়া দুইদলই চলে যাবে। ড্র করলে বা অস্ট্রিয়া জিতলে বাদ পড়বে পশ্চিম জার্মানি, সেক্ষেত্রে আলজেরিয়া আর অস্ট্রিয়া চলে যাবে পরের রাউন্ডে।
ম্যাচ শুরু হল এল মলিনোন স্টেডিয়ামে এবং প্রথম থেকেই পশ্চিম জার্মানির মুহুর্মুহু আক্রমণ। ১০ মিনিটের মাথায় হর্স্ট রুবেখ-এর গোলে ১-০ তে এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। কিন্তু তারপরের ৮০ মিনিট ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের কলঙ্কতম অধ্যায়। দুই দলই জানতো, এই ফলই তাদের দু’দলকে তুলে দিবে দ্বিতীয় রাউন্ডে, বাদ পড়বে আলজেরিয়া। প্রতিবেশী দু’দেশ তাই ম্যাচের বাকি সময়টা বলার মত কোন আক্রমণই করেনি। নিজেদের অর্ধেই নিজেদের মধ্যেই বল পাস দিচ্ছিলো তারা। প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড় কাছে আসলে ব্যাকপাস দিচ্ছিলো গোলরক্ষককে। কেবল পশ্চিম জার্মানির ড্রেমলার আর অস্ট্রিয়ার শাখনারই চেষ্টা করছিলেন স্বাভাবিকভাবে খেলতে। কিন্তু বাকি ২০ জনের লজ্জাজনক প্রদর্শনে ম্যাচটি পরিণত হয় পরিহাসে।
মাঠে বসে থাকা দুদলের সমর্থকরা বিরক্ত হয়ে যায় এই ‘পাতানো’ ম্যাচ দেখে। জার্মান ধারাভাষ্যকার এবারহার্ড স্টানজেক একপর্যায়ে ধারাভাষ্য না দিয়ে উঠে পড়েন। অস্ট্রিয়ার ধারাভাষ্যকার রবার্ট সিগার দর্শকদের টেলিভিশন বন্ধ করে দিতে অনুরোধ করেন। ক্ষুদ্ধ দর্শকরা খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্কনোট ছুঁড়ে মারেন। এক জার্মান দর্শক ক্ষুব্ধ হয়ে পতাকাও পুড়িয়ে ফেলেন।
এভাবেই পুরো ৯০ মিনিটের খেলা সমাপ্ত হয়। গোল ব্যবধানে বাদ পড়ে যায় আলজেরিয়া, কোয়ালিফাই করে পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়া।
ম্যাচশেষে ক্ষুব্ধ আলজেরিয়ান ফুটবল ফেডারেশন আবেদন জানায় ফিফাকে এই প্রহসনের ম্যাচ বাতিল করার। কিন্তু কোন নিয়মভঙ্গ না হওয়ায় ফিফা তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। পশ্চিম জার্মানি শেষপর্যন্ত টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়, অস্ট্রিয়া বাদ হয়ে যায় পরের রাউন্ডেই।
কিন্তু এই ম্যাচটির পরে টনক নড়ে ফিফার। তাই ১৯৮৪ সালের ইউরো আর ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ থেকে গ্রুপের শেষ রাউন্ডের দু’টি ম্যাচ একই সময়ে শুরু করার রীতি শুরু হয়। যেন বিশ্বকাপে এরকম আরেকটি প্রহসনের ম্যাচ দর্শকদের আর দেখতে না হয়।
Post Views: 805